Published on

ঘুণপোকা

২০০৭ সাল থেকে শুরু করে পরের দু’বছরে ১১ টা লাশ পাওয়া যায় চাঁদপুরের ডোবা, নর্দমা, খালগুলোর পাশে। ভিকটিমরা সবাই নারী। কাউকে খুন করা হয়েছে শ্বাসরোধ করে, কাউকে গলা টিপে, কাউকে পানিতে চুবিয়ে। সবাইকে খুন করার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে।

খুনের ধরন দেখে পুলিশের ধারণা হলো সবগুলো খুন এবং ধর্ষণের হোতা একজনই। দেশজুড়ে আলোড়ন পড়ে গেল। কে সেই সিরিয়াল কিলার? কেন সে মেতে উঠেছে এমন হত্যাযজ্ঞে?

২০০৯ সালের জুলাই মাসে পারভীন নামের এক নারীর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে দেখা মিললো চাঁদপুরের এক মসজিদে ফ্যান চুরির ঘটনায় আটক রসু খাঁ নামের এক মধ্যবয়স্ক লোকের। শুরু হলো জেরা। প্রথমে অস্বীকার না করলেও একসময় রসু খাঁ স্বীকার করলো যে, পারভীনকে সে-ই খুন করেছে। একে একে আরো ১০ জন নারীকে ধর্ষণের পর খুনের স্বীকারোক্তিও দিলো সে। পুলিশকে রসু খাঁ জানালো, তার জীবনের টার্গেট এভাবে ১০১ জন নারীকে হত্যা করা। তারপর সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে বাকী জীবন কাটিয়ে দেওয়া।

কিন্তু কেন এমন বিকৃত রুচির উন্মাদ খুনি হলো রসু খাঁ?

রসু খাঁ’র স্ত্রী গার্মেন্টসে চাকরি করতো। সেই সুবাদে বিভিন্ন গার্মেন্টস কর্মী মেয়েদের সঙ্গে তার পরিচয়। একপর্যায়ে এক নারী কর্মীর সঙ্গে প্রেম হয় তার। কিন্তু সেই নারী তার সঙ্গে প্রতারণা করে এলাকার অন্য এক ছেলের সঙ্গে প্রেমে জড়ায়। রসু খাঁ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে ওই কর্মী তার প্রেমিকের সহযোগিতায় ৫-৬ জন ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী দিয়ে ১টি পাঁচতলা ভবনের ছাদে তুলে বেদম মারধর করে তাকে। সেদিনই রসু খাঁ প্রতিজ্ঞা করে–১০১ জন নারীকে ধর্ষণ শেষে খুন করবে সে। শুরু হয় বিভিন্ন নারীদের সঙ্গে প্রেমের ভাব গড়া। এদের মধ্যে গার্মেন্টস কর্মীই বেশি। একপর্যায়ে সে ভাড়াটে খুনি হিসেবেও কাজ করতে শুরু করে। ১১ জনকে হত্যার কথা স্বীকার করলেও আসলেই সে ১১ জনকে হত্যা করেছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে[1] আদালতে ফাঁসির রায় হয় রসু খাঁ’র।

বলা হয়–অর্থই সব অনর্থের মূল। অনর্থের মূলের লিস্টে প্রথম স্থানটা অর্থের দখলে থাকলে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানটা নির্ঘাত প্রেমের দখলে যাবে। প্রেমের নামে হত্যা, যুদ্ধবিগ্রহ, বিশৃঙ্খলা আর ধ্বংসের ইতিহাস অনেক পুরনো। বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধ যেমন হয়েছিল হেলেন নামের এক মানবীর প্রেমের জন্য, তেমনি আজও ‘পবিত্র প্রেম’ জন্ম দিয়ে যাচ্ছে নানা ধ্বংসযজ্ঞের। এই যেমন বাংলাদেশের প্রথম সিরিয়াল কিলার রসু খাঁ’র আবির্ভাব হয়েছে ব্যর্থ প্রেমের ধ্বংসস্তূপ থেকে। নিঃসন্দেহে রসু খাঁ’র চালানো হত্যাগুলোর জন্য তার সেই প্রেমিকা দায়ী না। অবশ্যই একজন রসু খাঁ’র সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠার পেছনে অনেক সামাজিক, পারিবারিক এবং অন্যান্য ফ্যাক্টর কাজ করে। কিন্তু ব্যর্থ প্রেমের একটা ভূমিকা যে এখানে ছিল, সেই সত্যটা এতে বদলায় না।

অনেক সময়ই ব্রেকআপ তীব্র ক্রোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সে আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় প্রেমিক/প্রেমিকাসহ আরো অসংখ্য মানুষের জীবন। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ায় প্রাক্তনকে ধর্ষণ, বন্ধুদের নিয়ে গণধর্ষণ, খুন, যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তাকেও খুন, আপত্তিকর ছবি অনলাইনে ভাইরাল করে দেওয়া, এসিড মারা, এমনকি প্রেমিকার বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ, বড় বোনের সঙ্গে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ছোট বোনকে অপহরণ এর মতো অনেক ঘটনা এদেশে ঘটেছে। প্রাক্তনের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য অনেকে অন্য মেয়েদের উপর যৌন নির্যাতন আর হয়রানিও শুরু করে।[2]

পিছিয়ে নেই মেয়েরাও। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিককে খুন করার মতো ঘটনাও ঘটায় তারা। এই প্রেমের কারণে যে কতো পরিবার শেষ হয়ে যায়, মৃত্যু ঘটে কতো স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসার; তার কতোটুকু খবরই বা আমরা রাখি[3]

শুধু যে ব্রেকআপ বা ঝগড়ার কারণেই প্রেমের সম্পর্ক এমন সহিংস রূপ ধারণ করে, এমন না। সহিংসতা এমনিতেই প্রেমের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে মারামারি, একে অপরকে শারীরিক নির্যাতন করা, ধর্ষণ করা, ব্ল্যাকমেইল করা, এমনকি খুন করাও খুবই সাধারণ ঘটনা।[4]

বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত তথ্য উপাত্তের হিসেব তেমন একটা রাখা হয় না, তাই আমরা চোখ বুলাবো সুশীল প্রগতিশীলদের ‘বেহেশত’, অ্যামেরিকার দিকে। দেশব্যাপী জরিপ চালিয়ে অ্যামেরিকার Centers for Disease Control and Prevention Center, ২০১১ সালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়–প্রায় প্রতি ১০ জনে ১ জন হাইস্কুল স্টুডেন্ট তাদের বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডের হাতে গত বারো মাসের মধ্যে অন্তত একবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মেয়েদের মধ্যে প্রতি ৫ জনে ১ জন এবং ছেলেদের মধ্যে প্রতি ৭ জনে ১ জন ১১ থেকে ১৭ বছরের বয়সের মধ্যে তাদের সঙ্গী/সঙ্গীনীদের হাতে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে।[5] অন্য একটি পরিসংখ্যান অনুসারে দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতি ৫ জন হাইস্কুল ছাত্রীদের মধ্যে ১ জন তাদের প্রেমিকের দ্বারা শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।[6] এছাড়া প্রেমিক বা প্রেমিকার দখল নিয়ে অন্যের সাথে মারামারি, খুনোখুনি, গার্লফ্রেন্ডের আত্মীয়স্বজনের হাতে মারধোর ডালভাতের মতোই সাধারণ ঘটনা।[7]

ভালোবাসার খুব ট্যাশ, তাই না?

প্রেমের সাথে হাত ধরাধরি করে আসে মাদকও। প্রেমে বা ব্রেকআপের ভয়াবহ স্ট্রেস থেকে সাময়িক মুক্তি পাবার জন্য অনেকেই মাদকের শরণাপন্ন হয়।[8] কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সেন্টার অন অ্যাডিকশান অ্যান্ড সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউস-এর চালানো এক গবেষণায় দেখা যায় গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ডের সাথে যে যতো বেশি সময় কাটায় সে ততো বেশি মদ, গাঁজা, বিড়ি সিগারেটের নেশায় পড়ে যায়।[9] অনেকেই হয়তো প্রেম চলার সময় মাদকে আসক্ত হয় না। কিন্তু ব্রেকআপের পর ছ্যাঁকার কষ্ট ভুলতে মাদকে আসক্ত হয়ে যায়। প্রেম পিছু ছাড়লেও মাদক পিছু ছাড়ে না।

স্রেফ এই মাদকই একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেবার জন্য যথেষ্ট। জাতির যুবশক্তিকে মাদক একেবারে ভেতর থেকে কুরে কুরে খেয়ে নিঃশেষ করে দেয়। মাদককে কেন্দ্র করে সমাজে ব্যাপক অপরাধ সংঘটিত হয়। মাদকের টাকা জোগাড় করার জন্য বাবা-মাকে খুন করা, চুরি, ছিনতাই করা, ভাড়াটিয়া খুনি হিসেবে কাজ করা, মাদকের প্রভাবে ধর্ষণ করা–এগুলো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।[10] সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আবদুল হাকিম সরকার বলেন, আমাদের সমাজে ৮০ শতাংশ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে মাদকের কারণে। সমাজ পুরোপুরি মাদকমুক্ত করতে পারলেই অপরাধ এমনিতেই কমে যাবে।[11]

কেউ হয়তো, এখন আপত্তি তুলতে পারো–এ ধরনের ঘটনা সবার ক্ষেত্রে ঘটে না। অনেকেই প্রেম করে দিব্যি সুখে আছে। এমন কোনো কিছুর মুখোমুখি তাদের হতে হয়নি।

হ্যাঁ, একথা সত্য। প্রেম করলেই যে সব ক্ষেত্রে এমন হবে, এটা আমরাও বলছি না। আমরা যা বলছি তা হলো, প্রেমের জন্য এতো দুঃখ, কষ্ট, অপরাধ, ভোগান্তি, এতো ধ্বংস–তবু কেন সবসময় প্রেমকে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও সুখের পথ হিসেবে দেখানো হয়? কেন আমাদের মাথায় গেঁথে দেওয়া হয় প্রেম পবিত্র, প্রেম মহান, প্রেম স্বর্গ থেকে আসা? কেন মিডিয়া থেকে শুরু করে আমাদের সুশীল প্রগতিশীলরা সারাদিন এরই গুণকীর্তন করে যায়, কিন্তু এই কথাগুলো আমাদের বলে না? তোমাদেরকে শেখায় না?

একটু ভেবে দেখো তো, কোনো একটা খাবারের কারণে যদি এতোগুলো খারাপ জিনিস ঘটতো, তাহলে কি সেই খাবারটার ব্যাপারে সতর্ক করা হতো না? সেই খাবারের প্যাকেটে বড় বড় অক্ষরে সতকর্তাবাণী লেখা থাকতো না, যেমনটা লেখা থাকে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে? কোনো একটা কাজের কারণে যদি এতো এতো নেতিবাচক ফল আসতো তাহলে সেই কাজটার ব্যাপারে কি সতর্ক করা হতো না?

কিন্তু প্রেমের ব্যাপারে হয় ঠিক উল্টোটা।

বিষয়টা অদ্ভুত না?

আকাশের ওপারে আকাশ বই থেকে...


[1] যেভাবে রসু খাঁ সিরিয়াল কিলার, বাংলাদেশ জার্নাল, মার্চ ৬, ২০১৮- tinyurl.com/59n2rzs6

প্রেমে ব্যর্থ সিরিয়াল কিলার রসু খাঁ’র ফাঁসি, সংবাদবিডি- tinyurl.com/54n5bbeu

[2] প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আড়ং এর নারীকর্মীদের গোপন ভিডিও ধারণ করতেন সজীব, সময় নিউস, জানুয়ারি ১৮,২০২০- tinyurl.com/ycyzyxch

বিয়ে না করায় প্রেমিকার আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছাড়লেন প্রেমিক, বাংলাভিশন, মার্চ ২৭, ২০২২- tinyurl.com/nc9dz3sz

বড়বোনের সঙ্গে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ছোট বোনকে অপহরণ ! Somoy TV ইউটিউব ভিডিও, Aug 19, 2022-tinyurl.com/5b97kytb

[3] রাঙ্গুনিয়ায় প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এসিড ছুঁড়ে ঝলসে দিল প্রেমিকার শরীর, প্রেমিক গ্রেপ্তার, aazkaalbangla.com,মে ৮, ২০২২ - tinyurl.com/522s5spj

প্রেমিকার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হওয়ায় বন্ধুকে হত্যা, রাইজিংবিডি.কম, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২২-

tinyurl.com/yup777tu

প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ের কথা, তরুণীকে মেরে নিজেকেও শেষ করল প্রেমিক, ঢাকা পোস্ট, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২- tinyurl.com/mrxuynrz

সম্পর্কে না ফেরায় প্রাক্তন প্রেমিকার বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ, জাগোনিউজ২৪, মে ১৪ ২০২২ –tinyurl.com/3nbnnz5y

প্রেমে ব্যর্থ হয়ে পলাশে প্রেমিককে খুন, যুগান্তর, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২-

tinyurl.com/2fa5ypz5

[4] প্রেমিকাকে নির্মমভাবে হত্যা করলো প্রেমিক, লোমহর্ষক বর্ণনা | Sanjida Murder, Jamuna TV ইউটিউব ভিডিও, Aug 17, 2022- tinyurl.com/46u6tzwx

[5] Youth Risk Behavior Surveillance — United States, 2011,Center for Disease Control and Prevention, June 8, 2012 - tinyurl.com/cz42nacm

[6] এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই জরিপে দেখা যায় নারীরা প্রেমের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় ব্যাপক মাত্রায় সহিংসতা প্রকাশ করে।

The Sexual Assault Statistics Everyone Should Know, campussafetymagazine.com, March 05, 2018- tinyurl.com/bdfefeva

[7] মিন্নির দায় স্বীকারের সেই লোমহর্ষক জবানবন্দী!বার্তা২৪.কম, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০- tinyurl.com/bdzkf56d

প্রেমিকা নিয়ে দ্বন্দের জের নীলফামারীতে বন্ধুর ছুরিকাঘাতে শিক্ষার্থী খুন,uttorbangla.com, জুলাই ৪, ২০২০-tinyurl.com/yzu75822

[8]Angulski, K., Armstrong, T., & Bouffard, L. A. (2018). The influence of romantic relationships on substance use in emerging adulthood. Journal of Drug Issues, 48(4), 572-589.

Consequences of Teen Dating Violence, youth.gov- https://archive.is/B2xkO

[9] The Negative Effects of Teenage Dating, studymoose.com- tinyurl.com/5yx8ytsh

[10] ধর্ষণ, খুনসহ অধিকাংশ অপরাধের পেছনেই মাদক, ড. অরূপ রতন চৌধুরী, মানবকণ্ঠ, ডিসেম্বর ০৬, ২০২০- tinyurl.com/3rp6sam7

মাদকের টাকার জন্য মাকে হত্যা করেছে ছেলে, অভিযোগ বাবার, এনটিভি, ০৫ নভেম্বর, ২০২১- tinyurl.com/2p842uea

মাদকের টাকা না দেওয়ায় মাকে খুন করলো মেয়ে! দৈনিক ইত্তেফাক , মার্চ ০১, ২০২১- tinyurl.com/38ycvxvu

[11] বন্ধুর মাধ্যমেই মাদক জগতে ঢুকছে বেশিরভাগ তরুণ,

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম,মে ৬, ২০১২- tinyurl.com/yb4992fr