- Published on
ওর সাথে পালালাম - ৩
দেখো, তোমাদের এই বয়সটাতে আসলে সংসার জগৎ সম্পর্কে তেমন ধারণা থাকে না। তোমরা ভাবো যে অনেক বড় হয়ে গেছো, অনেক কিছু বুঝে ফেলেছো; কিন্তু আদতে সংসারের অলিগলি সম্পর্কে তোমাদের ধারণা থাকে প্রায় শূন্যের কোঠায়।
প্রেম করা আর বিয়ে করে এক ছাদের নিচে থাকা আসলে এক জিনিস না। তোমার কি মনে হয় রোমিও-জুলিয়েট বা লাইলী-মজনু ঘর বাঁধার সুযোগ পেলে রূপকথার মতো সুখে শান্তিতে বসবাস করতো? বিয়ের পাঁচ বছর পর বা দুই বাচ্চার মা হবার পর বিয়ের আগে প্রেম করা অবস্থায় তারা যেমন জীবনের স্বপ্ন দেখতো তেমন জীবন যাপন করতে পারতো? আচ্ছা বলো তো, বেশির ভাগ নাটক কিংবা সিনেমায় শুধু বিয়ের আগের প্রেম থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত কেন দেখানো হয়? কেন পরের অংশ দেখানো হয় না?
একটু খোলাখুলি কথা বলি। সত্য প্রকাশে আসলে লজ্জা করতে হয় না। ‘একে অন্যকে ছাড়া বাঁচবো না’, ‘ওকে ছাড়া আমি কাউকে স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারবো না’, একদিন না দেখলে পাগলের মতো হয়ে যাওয়া (হালের আঁতেল সাহিত্যিকরা যাকে ‘তোমাকে দেখার অসুখ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে), এক ঘণ্টা ইনবক্সে আপডেট না পেলে অস্থির লাগা–এসব কিছুর পেছনেই শরীরের রহস্য একটা বড় ফ্যাক্টর।
বিয়ের আগে একজন অপরকে পরিপূর্ণরূপে আসলে পায় না।[1] একটা রহস্য, একটা রোমাঞ্চ থেকেই যায়। বিয়ের পর এই রহস্যের জট আস্তে আস্তে খুলতে থাকে। মাথা ঠাণ্ডা হয়। কৌতূহল মিটে যায়। সেই সাথে কমতে থাকে আগেকার আবেগ-অনুভূতিগুলোর তীব্রতা। পাশাপাশি বিয়ের আগে প্রায় সকল মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকে একটা ইচ্ছাকে কেন্দ্র করে–‘ওকে আমার বউ বানাতেই হবে’ বা ‘ওকে আমার স্বামী করতেই হবে’। বিয়ের পরে তো এ ইচ্ছা পূর্ণ হয়ে যায়। শরীরের রহস্য উন্মোচিত, নিজের তীব্র ইচ্ছাও পূর্ণ…মোহ, আবেগ কমে যায়, একসময় একেবারে হারিয়েই যায়। মোহের চশমা খুলে তখন বাস্তবতার চোখে পরিষ্কারভাবে সব কিছু দেখা শুরু হয়।
বাসা থেকে পালানোর সময় সঙ্গে করে কিছু টাকা, স্বর্ণের গহনা ইত্যাদি নিয়ে যাবে হয়তো। কোনো বন্ধু, আত্মীয় বা হোটেলে উঠবে। কয়েকদিন পর যখন আত্মীয়ের বাসায় আর থাকা সম্ভব হবে না, বা টাকা ফুরিয়ে যাবে তখন ভালোবাসাটাও আস্তে আস্তে ফুরাতে শুরু করবে।
ভাইয়া, প্রেম করার সময় বাপের হোটেলে খেতে তুমি। টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করা লাগতো না, এখন টাকা কামানোর জন্য তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে। অনেক অড জব করতে হবে। একদিন হয়তো ভালো লাগবে, দুইদিন হয়তো মনে হবে যে, তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষের জন্য কষ্ট করছো, আত্মতৃপ্তি আসবে…কিন্তু কিছুদিন পর পরিশ্রমের ধকল সামলাতে পারবে না।
আপু, বাসায় থাকতে হয়তো তুমি জীবনেও রান্নাঘরের চৌকাঠেও পা রাখোনি, খাবার জন্য হয়তো বিছানা থেকেও নামোনি, বিছানাতে খাবার দিয়ে গেছে। তোমাকে এখন কালিঝুলি মেখে রান্না করা লাগবে, হয়তো বস্তি টাইপের বাসায় থাকা লাগবে। ঘরের সব কাজ করা লাগবে। একদিন দুইদিন ভালো লাগলেও বেশিদিন এমন জীবন যাপন সহ্য করতে পারবে না।
তোমাদের আগে যে লাইফস্টাইল ছিল, যে খাবার দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদে অভ্যস্ত ছিলে, সেটা আর পাবে না। অনেক, অনেক, আবারো বলি, অনেক সংগ্রাম করতে হবে। সংসারে অভাব অনটন আসবে। অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে শরীরে ক্লান্তি আসবে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে। শুরু হবে সংসারে অশান্তি, গণ্ডগোল, মারামারি! এখান থেকেই শুরু হবে বিচ্ছেদের পথ!
দেখো, মানুষের অন্তর শুধু প্রেমিক বা প্রেমিকাকে ভালোবেসে বা ভালোবাসা পেয়ে সন্তুষ্ট হতে পারে না। আল্লাহ মানুষকে এভাবে বানাননি। মানুষের অন্তরে বাবা, মা, ভাই, বোনের জন্য ভালোবাসার একটা স্থান আছে। এই ভালোবাসা অন্য কিছু দিয়ে পূরণ হবে না। খালিই থেকে যাবে। পরিবার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে পালিয়ে গিয়ে তুমি ভালোবাসার এই স্থানটা অপূর্ণ রেখে দিচ্ছো। মোহ কেটে যাবার পরপরই হৃদয়ের এই অপূর্ণ স্থান থেকে অনবরত রক্তক্ষরণ হবে তোমার। বিশেষ করে সংসারের প্রকৃত নির্মম, কঠোর বাস্তবতা তোমার সামনে এসে হাজির হবার পর। মানুষের জীবনে পরিবার খুব গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করে নিজেকেই আল্লাহর আসনে বসানো পাশ্চাত্য সভ্যতা পরিবারকে টুকরো করতে করতে এখন ‘নাই’ করে ফেলেছে। এতে ভেঙে পড়েছে তাদের জীবন ব্যবস্থা। হতাশা আর চরম অবসাদে ভুগে নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেও দেরি হয়ে গিয়েছে। সুপারসনিক গতিতে তারা এগুচ্ছে পতনের দিকে।[2]
বাসার আরাম আয়েশ, বাবা-মার আদর ভালোবাসার কথা বারবার মনে পড়তে থাকবে তোমার। প্রতিবার টাকার অভাবে পড়লে, কাজের কঠোর পরিশ্রমের সময় তোমার মনে পড়বে বাবার কথা, বড় ভাইয়ের কথা…ইশ! তারা যদি থাকতো, এভাবে মানুষের ঝাড়ি খেয়ে কাজ করা লাগতো না সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য। ইশ! তারা থাকলে আমাকে টাকার জন্য এতো চিন্তা করা লাগতো না!
দুপুরে বা রাতে খেতে বসে তোমার বারবার মনে পড়বে বাসার সেই মজার খাবারগুলোর কথা। মা আদর করে, যত্ন করে তোমাকে খাওয়াচ্ছেন। মনে হবে ভাইয়ের সাথে খুনসুটি, দুষ্টুমির কথা। বোনের কপট শাসন, রাগের কথা। হয়তো ভীষণ ভাবে মিস করবে বাড়ির বেড়াল, পাশের বাসার ফোকলা দাঁতের পিচ্চি বা ছক্কা হাঁকানো সেই ক্রিকেট মাঠ, অথবা বাড়ির সামনের বকুল গাছটার কথা। অতীত স্মৃতির ডালপালা সাজিয়ে হাজির হবে ঈদের দিনগুলো। এক অদৃশ্য কারাগারের কয়েদি মনে হবে নিজেকে। চোখ ভিজে যাবে জলে।
এই হাহাকার, অভাব-অনটন, পালানোর পরে দুজনে একসাথে রূপকথার মতো সুখী জীবন যাপনের স্বপ্ন মিথ্যে হয়ে যাওয়া, ঝগড়া, অশান্তি–সবকিছুর জন্য তখন দায়ী মনে হবে ওকে। অভিযোগের আঙুল উঠে যাবে সেই মানুষটার দিকে যার জন্য তুমি বাকি সব কিছুকে, বাকি সবাইকে তুচ্ছ করেছিলে। তখন তোমার মনে হবে–ওর জন্যই আমার আজকে এই অবস্থা!
অনেকেই হয়তো ভাবে, পালিয়ে গিয়ে বিয়েটা একবার করে ফেললেই বাবা-মা মেনে নিতে বাধ্য হবে। বিয়ে যেহেতু করেই ফেলেছে এখন তো আর কিছু করার নেই মেনে নেওয়া ছাড়া। মানসম্মান আরো বেশি হারানোর ভয়ে মেনে নেবে, বা একটা বাচ্চা হয়ে গেলে নাতিনাতনীর মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা-মা আর রাগ করে থাকতে পারবে না। এটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্যি। তবে সবসময় যে এমন হয়, তা না। আর উপরে উপরে মেনে নিলেও আজীবন বাবা-মা’র মনে আক্ষেপ থেকেই যায়। সন্তান পালিয়ে গিয়ে মানসম্মানের যে ক্ষতি করেছে, যে কষ্ট দিয়েছে, বাবা-মা’র উপর প্রেমিক/প্রেমিকাকে প্রাধান্য দেবার বিষয়টা সবার সামনে প্রমাণ করেছে–এই বিষয়গুলো তারা ভুলতে পারেন না। মন থেকে মেনে নিতে পারেন না। একটা অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি হয়ে যায় সন্তানদের সাথে। দু’আ, ভালোবাসা, আদর, মায়ামমতার সুতো আলগা হয়ে যায়। মনে হয় বাবা-মা আর সন্তানদের নিয়ে একটা ধারাবাহিক নাটক চলছে। সবাই যে যার ভূমিকায় সুনিপুণ অভিনয় করে চলেছে। কিন্তু বাইরে থেকে সবকিছু দেখলে স্বাভাবিক মনে হলেও কিছুই স্বাভাবিক থাকে না। সুখ থাকে না।
আর এভাবে উপরে উপরে মেনে নিতেও যে সময়টা লাগে এই সময়ের ভেতরেই সংসারের গুঁতা খেয়ে হালুয়া টাইট হয়ে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ টাইপের অবস্থা হয়ে যায়। কড়ায় গণ্ডায় মিটে যায় বিয়ের শখ। প্রেমিক, প্রেমিকাকে ছেড়ে পালায় বা ডিভোর্স হয়ে যায়।
[1] যদি যিনা-ব্যভিচারে না জড়ায়, বা অল্প কয়েকবার জড়ায়। আর যারা বিয়ের আগেই ফুলটাইম স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবন যাপন করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিয়ের পরপরই তাদের সম্পর্কের বারোটা বেজে যায়।
[2] সামনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হবে ইন শা আল্লাহ।