- Published on
ভুলে ভরা স্বপ্ন! (প্রথম কিস্তি)
বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম।
.
ব্যাপারটা বেশ ঝামেলার । শীতকাল হলে তো কথায় নেই। মাঝেরাতের ঘুম ভাংগা চোখ। ট্রাউজার, লেপ,কম্বল ভিজে একাকার চিটচিটে, আঠালো লিকুইডে । গা গুলোয়। পানি গরম করা,বালতি নিয়ে টানাহেঁচড়া, বাবা,মা, ভাই,বোনদেরকে লুকিয়ে খুব সাবধানে গোসল করা। কি ভীষন লজ্জা! বাবা,মা একটু অন্যরকম ভাবে তাকালেও সন্দেহ হয় এই বুঝি বুঝে গিয়েছে !
.
একটু বয়স হয়ে যাওয়ার পর সবাই কমবেশী সামলিয়ে নেয়, কিন্তু কৈশোরে বা প্রথম তারুন্যে স্বপ্নদোষ খুবই ভীতিকর এক অভিজ্ঞতা।দশ বারো বছরের বাচ্চা একটা ছেলে হুট করে যখন এক রাতে ঘুম ভেংগে দেখে তার প্যান্ট ভিজে গিয়েছে আঠালো লিকুইডে তখন তার ঘাবড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। দেহের আকস্মিক এই পরিবর্তনের রহস্য উদঘাটনে সে শরনাপন্ন হয় বন্ধু,পাড়ার ভাই বেরাদর,কাজিন বা নিজের ভাই বোনদের কাছে। বাবা মা বা অন্য কোন গুরুজনদের সংগে তার দৈহিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করার কথা সে ভুলেও ভাবে না। কিছুটা লজ্জা আর বাকীটা জেনারেশান গ্যাপ। স্বপ্নদোষ সম্পর্কে আমাদের সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার,হাতুড়ে ডাক্তার,হারবাল কোম্পানীর দৌরাত্ম্য,সঠিক তথ্যের অপ্রতুলতার কারনে একগাদা ভুল ভাল তথ্যে বোঝায় হয় ছোট্ট মস্তিষ্ক। সে ঘাবড়িয়ে যায় আরো। শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
.
অথচ মুসলিমদের এরকমটা হবার কথা ছিলনা। অপ্রয়োজনীয় লজ্জা বিলাসিতা করা মুসলিমদের সাজে না। খোদ রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) মহিলা সাহাবীরা স্বপ্নদোষের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছেন," ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আল্লাহ সত্য প্রকাশে লজ্জিত হন না, একজন মহিলার স্বপ্নদোষ হলে তাকে কি গোসল করতে হবে"? [১] আমরা লজ্জার দোহাই দিয়ে অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাই। গুরুজনদের এই বিষয় গুলো নিয়ে প্রশ্ন করাকে বেয়াদবি মনে করি।ভাবখানা এমন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আর তার সাহাবীদের (রাঃ) চেয়েও বেশী লজ্জাশীল হয়ে গিয়েছি! আমরা তাদের চেয়েও বেশী আদব কায়দা জানি! আফসোস!
.
আমাদের এই ব্যাপারগুলো নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা উচিত। তার মানে আবার এটা নয় যে, আমার স্বপ্ন দোষ হয়েছে, এই বলে বাজারে ঢোল পিটাব। একটু মাথা খাটালেই, শালীনতা বজায় রেখে খুবই কার্যকরী ভাবে স্বপ্ন দোষ নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করে সঠিক তথ্য গুলো সবাইকে জানানো যায়। মসজিদগুলোকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। ইমাম সাহেব বা কম বয়সী কোন আলিম একদিন মহল্লার সকল উঠতি ছেলেদেরকে মসজিদে দাওয়াত করলেন। কিছু খাওয়া দাওয়া, গল্প গুজব হলো। এরই ফাকে ফাকে পর্ন,মাস্টারবেশনের অপকারিতা, চোখের হেফাযতের গুরুত্ব, স্বপ্নদোষ, পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব এবং পদ্ধতি নিয়ে আলাপ আলোচনা করা হল। খুঁজলে এমন অনেক চিকিৎসক পাওয়া যাবে যারা খুব আগ্রহের সংগে এইধরনের প্রোগ্রামে অংশগ্রহন করবেন। একটু আন্তরিকতা আর সদিচ্ছা থাকলেই সমাজের বিশুদ্ধতম মানুষগুলোর কাছ থেকে আমাদের কিশোরেরা এই অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
.
সেক্স এডুকেশানের পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালার কোন দরকার নেই,দরকার নেই বিদেশী এনজিওর সাহায্য নিয়ে আলফ্রেড কিনসির এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ করে দেওয়ার। খুব কম লজিস্টিক সাপোর্ট আর স্বল্প বাজেট দিয়েই কোয়ালিটি সেক্স এডুকেশান নিশ্চিত করা সম্ভব।
.
আল্লাহর কসম! আমাদের মসজিদগুলো আজ বিরান হয়ে গিয়েছে। কুরআনের দারস নেই, হাদীসের হালাকা নেই। রোবটের মতো মানুষগুলো সিজদাহ দিয়ে নামায পড়ে,তারপর বের হয়ে আসে। মসজিদ কমিটির সদস্যদের এইগুলো নিয়ে তেমন কোন মাথাব্যাথা নেই। তাদের সব মাথাব্যাথা মসজিদে এসি লাগানো,টাইলস লাগানো নিয়ে।জাতি হিসেবে কোথায় চলেছি আমরা? মসজিদে তরুনেরা কুরআন নিয়ে বসতে ভয় পায়! হালাকা করতে ভয় পায়! খতীব সাহেবেরা দ্বীনের কথা,আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) কথা বলতে ভয় পান!
.
আক্ষেপের প্যাচাল বাদ দিয়ে আসল কথাই আসি।
স্বপ্নদোষ কি?
.
স্বপ্নদোষ হল ঘুমের মধ্যে নারী পুরুষের অন্তরংগতার স্বপ্ন দেখে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রাইভেট'স পার্ট থেকে বীর্য বের হয়ে আসা।
স্বপ্নদোষ সাধারনত রাতে হয়ে থাকে। একারনে একে একাডেমিক্যালি Nocturnal Emissions বলা হয়। তবে মাঝে মধ্যে দিনেও স্বপ্নদোষ হয়ে থাকে।[২] সকল পুরুষেরাই জীবনে অন্তত একবার হলেও এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেয়ে থাকেন।
.
ইসলামী শরীয়া অনুসারে, স্বপ্নদোষ হল একজন বালকের প্রাপ্তবয়স্ক হবার অন্যতম একটি নিদর্শন। প্রথমবার স্বপ্নদোষ হবার পর থেকেই একজন বালককে প্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং শরীয়া তার ওপর কার্যকর হবে। [৩]
সাধারনত ১২-১৩ বছর বয়স থেকে স্বপ্নদোষ শুরু হয়। ছেলেদের যেমন স্বপ্নদোষ হয়,তেমন মেয়েদেরও স্বপ্ন দোষ হয়।
.
কেন হয় স্বপ্নদোষ?
.
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন।নির্দিষ্ট করে বলা যায় না ঠিক এই এই কারনে স্বপ্নদোষ হয়।
.
স্বপ্নদোষ হওয়া শুরু হয় বয়ঃসন্ধিকালে যখন পুরুষের শরীরে টেসটোসটেরন [৪] হরমোন তৈরি হওয়া শুরু হয়। এই হরমোনের প্রভাবেই পুরুষ, পুরুষালী আচরন করে, নারী পুরুষ একে অপরের প্রতি দৈহিক আকর্ষণ বোধ করে। টেসটোসটেরন হরমোন বীর্য প্রডাকশনে সাহায্য করে।
টেসটোসটেরনের পরিমান স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে হলে পুরোনো বীর্য স্বপ্নদোষের মাধ্যমে বের হয়ে যায় এবং নতুন বীর্য তৈরি হয়।
.
দীর্ঘ সময় ধরে যৌননিষ্ক্রিয়তা স্বপ্নদোষের আরকেটি সম্ভাব্য কারন। যৌননিষ্ক্রিয়তা, টেসটোসটেরনের পরিমান বাড়িয়ে দেয়,যার ফলশ্রুতিতে স্বপ্নদোষ হয়। [৫]
.
মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্তি,টাইট পোষাক পড়ে ঘুমানো, দেরী করে ঘুমানো এবং দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা,সকালে ঘুম ভাংগার পরে আবার ঘুমানো, সবসময় সেক্স ফ্যান্টাসিতে বুঁদ হয়ে থাকা এইগুলোও স্বপ্নদোষের সম্ভাব্য কারন।
.
কত দিন পর পর স্বপ্নদোষ হয়?
.
নির্দিষ্ট করে বলার উপায় নেয়। কারো কারো এক সপ্তাহ পর পর আবার কারো কারো তিন- চার সপ্তাহ পর পর স্বপ্নদোষ হয়।
.
স্বপ্নদোষ কি ক্ষতিকর?
.
এটি নিয়ে বেশ বিভ্রান্তিমূলক কথা বার্তা ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের সমাজে। স্বপ্নদোষ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক একটা ব্যাপার। এটা শরীরের জন্য মোটেও ক্ষতিকর নয়।
.
আল্লাহ (সুবঃ) শুধুমাত্র সেই সব বিষয় হারাম করেছেন যেগুলো মানুষের জন্য ক্ষতিকর। যেমন ধরুন, মদ,গাঁজা। মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ (সুবঃ) এগুলোকে হারাম করেছেন। স্বপ্নদোষ সম্পুর্ন প্রাকৃতিক একটা ব্যাপার। এটাকে আল্লাহ (সুবঃ) হারাম করেননি।বরং এটাকে বানিয়েছেন সাবালকত্বের নিদর্শন। ইরশাদ হচ্ছে, "আর যখন তোমাদের সন্তানেরা বয়ঃপ্রাপ্ত হয় (স্বপ্ন দোষের মাধ্যমে)..." [৬]
.
আলী (রাঃ) থেকে বর্নিত,রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন," তিন ব্যক্তির আমলনামা হতে কলম গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে;
১) ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম থেকে জাগ্রত হবার আগ পর্যন্ত।
২) শিশুদের প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগ পর্যন্ত
৩)পাগলের হুশ হবার আগ পর্যন্ত [৭]
.
একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি নিজেও জানেনা ঘুমের ঘোরে সে কি করছে।তখন তার আমল লিপিবদ্ধ করা হয় না। স্বপ্নদোষ হয়ে থাকে ঘুমন্ত অবস্থায়।এবং এটাকেও আমলনামায় লিপিবদ্ধ করা হয় না। [৮]
.
স্বপ্নদোষ যদি ক্ষতিকরই হতো,তাহলে আল্লাহ (সুবঃ) অবশ্যই অবশ্যই একে হারাম করতেন এবং স্বপ্নদোষের কারনে শ্বাস্তির ব্যবস্থা করতেন। তিনি এর কোনটাই করেননি। কাজেই আমরা মুসলিমরা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে নিতে পারি স্বপ্নদোষের কোন ক্ষতিকর দিক নেই।
.
চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুসারেও স্বপ্নদোষ ক্ষতিকর নয়।[৯]
চলবে ইনশা আল্লাহ......
রেফারেন্সঃ
[৬] সুরা নুরঃআয়াত ৫৯
[৭] তিরমিযী ১৩৪৩,ইবনে মাজাহ ৩০৩২,আল নাসাঈ ৩৩৭৮। হাদীসের মান হাসান।