Published on

মিথ্যায় বসত

প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে আমরা একটা মোহের মধ্যে থাকি। শত বাস্তবতা আর তথ্য উপেক্ষা করে বুঁদ হয়ে থাকি কল্পনার এক জগতে। প্রশ্ন হল, এই কল্পজগৎ কীভাবে তৈরি হলো?

আমরা এমন এক কালচারের মধ্যে বসবাস করছি যা ছোটবেলা থেকেই মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে যে, মানব অস্তিত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রেম খুঁজে ফেরা, প্রেমের মাঝে জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া, প্রেমকে জীবনের উদ্দেশ্য বানিয়ে নেওয়া, প্রেমের জন্য জীবন দেওয়া, প্রেমের জন্য মারামারি করা ইত্যাদি। গল্প, উপন্যাস, সিনেমা, নাটক, টিভি সিরিয়াল, মিউযিক ভিডিও, বিজ্ঞাপন, পত্রিকার পাতা, বিলবোর্ড–সবগুলো মাধ্যম থেকে প্রচারিত হচ্ছে একই গল্পের নানা সংস্করণ।

ছোটকাল থেকে শুনে আসা ডিযনির সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু গল্পের কথা চিন্তা করুন। সিনডারেলা, বিউটি অ্যান্ড দা বিস্ট, রাপুনযেল, স্নো ওয়াইট, লিটল মারমেইড–প্রত্যেকটা গল্পে একটা কমন থিম পাবেন। গল্পের মূল চরিত্রের জীবন ছিল মলিন, কষ্টের। হঠাৎ পবিত্র ভালোবাসার জাদু স্পর্শে সেই জীবন সুন্দর, উপভোগ্য আর মোহনীয় হয়ে গেল। মেসেজটা স্পষ্ট। প্রেমের কষ্টিপাথরে মরচে পড়া জীবন আমূল বদলে স্বর্ণ হয়ে যায়। কোনো মানুষ গল্পের প্রথম অংশের মনমরা ফিকে হওয়া জীবন চায় না। সবাই চায় গল্প শেষের ঘোরলাগা চোখের সুখের দিনগুলো। ঠিক একই ধরনের মেসেজ পাওয়া যায় বলিউডের হাজারো সিনেমা আর দেশের নাটক-সিনেমা, উপন্যাস আর গল্পগুলোতে।

কথাগুলো কাউকে বলে দিতে হয় না। লিখে দিতে হয় না বানান করে করে। আমাদের মন ও মস্তিষ্ক সহজাতভাবে মেসেজটা ধরতে এবং এর মর্মোদ্ধার করতে পারে। প্রেম শুধু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ না, প্রেম ছাড়া জীবন রঙহীন, নিষ্প্রাণ। রূপকথার রাজপুত্রের গল্প রাজকন্যাকে ছাড়া অপূর্ণ। রাজপুত্রের প্রেম ছাড়া রাজকন্যার অস্তিত্ব অর্থহীন। মানবজন্মের স্বার্থকতা হল প্রেমে। জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার চূড়ো হলো প্রেম। প্রেমই মুখ্য, প্রেম ছাড়া বাকি সব কিছু সাইডস্টোরি, বাকি সবাই এবং সব কিছু পার্শ্বচরিত্র।

আর এভাবেই এক সময় এই বিচিত্র বিশ্বাস প্রচলিত হয়ে যায়। রাস্তায়, রিকশায়, পার্কে, বাসে উপচে পড়া প্রেমের ভিড়ে চলাফেরা একসময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একুশে থেকে পহেলা বৈশাখ, শোক দিবস থেকে বিজয় দিবস, সব ছুটির দিন একসময় পরিণত হয় ভ্যালেন্টাইনে। মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, সমাজ, সংস্কৃতি সব আমাদের এই দিকে ঠেলে দেয়। হাইস্কুলের ছাত্র থেকে চল্লিশের ঘরে পা দেওয়া বিবাহিত মানুষগুলো পর্যন্ত সবাই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় ঐ ‘পবিত্র প্রেম’কে, যা তাদের অর্থহীন জীবনকে অর্থ এনে দেবে।

কিন্তু এই কল্পজগতের সাথে বাস্তবতার মিল কতোটুকু? রূপকথা আর রূপালি পর্দা থেকে ধার করা এই স্বপ্নগুলোর বাস্তব পরিণতি আসলে কী?

প্রেমের এই গল্প যে মিথ্যে তার কয়েকটা দিক আমরা এরই মধ্যে আলোচনা করেছি। প্রেমে পড়ার উথালপাথাল অনুভূতি আর বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গ পাবার তীব্র ইচ্ছের পেছনে থাকে হরমোন আর যৌনতার প্রভাব। কিন্তু প্রেমের এই মিথগুলোর মিথ্যে হবার আরো কিছু দিক আছে।

প্রেমের মিথের আরেকটা বড় মিথ্যা হলো সাময়িক মোহকে চিরন্তন হিসেবে দেখানো। সেই অনাদিকাল থেকে মোহ আর প্রেমের কতো ফুল ফুটলো! কতো প্রেমিক-প্রেমিকা প্রেমের শপথ করে কবিতা আউড়ে কসম খেলো–ভালোবাসার জন্যে তারা জীবন বিলিয়ে দেবে নিঃশঙ্কচিত্তে, আপন করে নেবে দুঃখের প্রত্যেকটি দ্বীপকে, দরকার হলে দাঁড়িয়ে যাবে পুরো পৃথিবীর বিপক্ষে, তবুও ভালোবাসার অসম্মান হতে দেবে না। পরম আদরে ভালোবাসাকে বুকে জড়িয়ে রাখবে আজীবন, আকাশ বাতাস আর যমীনকে সাক্ষী রেখে তারা উদাত্ত কণ্ঠে জানান দিলো–জীবন চলে গেলেও অন্য কাউকে মেনে নেবে না জীবনসঙ্গী হিসেবে। অথচ কক্ষপথে কিছুটা পরিভ্রমণ শেষে একটু বুড়ো হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে বসে সেইসব বোকা, মিথ্যুক প্রেমিকের দল অন্য কারো চোখে চোখে রেখে আবারো খেলো সেই একই পুরোনো কবিতার মিথ্যা কসম!

ফিযিক্সেরথিওরি, ফেইসবুকেরট্রেন্ড, রাজনীতি, সিংহাসন, নিয়ন আলোর রাজপথ… আল্লাহর কালাম আর দ্বীন ছাড়া সবকিছুই বদলে যায় সময়ের সাথে সাথে।প্রেমও তাই।মোহ কেটে গেলে, নেশা কেটে যায়।প্রেমও হারিয়ে যায় খুব দ্রুত।কিন্তু তার আগে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় একেকটা জীবন…উহু, শুধু জীবন না।ছারখার করে দেয় পরিবার, সমাজ… এবংসভ্যতা!

আকাশের ওপারে আকাশ বই থেকে।