Published on

অশনি সংকেত

বাংলাদেশের শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের অবস্থা কী? আমাদের সমাজের কতোটা গভীরে পর্নমুভি প্রভাব বিস্তার করেছে ?

বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক Dr. Victor B. Cline সঙ্গে। Dr. Victor B. Cline ছিলেন University of Utah’র Emeritus Professor,পড়াতেন Psychology , University of California, Berkeley থেকে Psychology’র ওপর Ph D

ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। পরনোগ্রাফির প্রভাব নিয়ে আজীবন করে গিয়েছে অসংখ্য গবেষণা। [১]

.

Dr. Victor B. Cline আমাদের বলছেন পর্ন আসক্তির সূচনা থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে বেশ কয়েকটি ধাপ পার করতে হয়।

ধাপগুলো হচ্ছে,

১) Addiction

২) Escalation

৩) Desensitization

৪) Acting Out

. যদিও তাঁর এই মডেল ‘ব্যক্তি কেন্দ্রিক’ তারমানে এই মডেল দিয়ে একজন ব্যক্তির পর্ন আসক্তি ব্যাখ্যা করা যায়, তারপরেও আমরা মনে করি এই মডেল দিয়ে বাংলাদেশের সমাজে পরনোগ্রাফির সামগ্রিক প্রভাব ব্যাখ্যা করা সম্ভব। [২]

.

মহামারী আকারে বাংলাদেশের কিশোর তরুণদের পর্ন আসক্তির সূচনা হয়েছে বেশ কয়েকবছর পূর্বেই। স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট সহজলভ্য হবার পূর্বে সিডি ভাড়া করে কিশোর, তরুণরা পর্ন দেখত। ২০০৫ সালের দিক থেকে এমপি ফোর, এমপি ফাইভ টাইপের গান শোনা এবং দেখার ডিভাইস গুলো বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে থাকে। সেই সময় কম্পিউটারের দোকান থেকে টাকা দিয়ে এইসব ডিভাইসে পর্ন লোড করে নিত কিশোর তরুণরা। কিন্তু তখনো পর্ন আসক্তি মহামারী আকারে পৌঁছায়নি।

২০০৭ সাল থেকে বা এর পর থেকে মাল্টিমিডিয়া ফোন সহজলভ্য হতে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে পর্ন আসক্তি। কিন্তু তখনো মহামারী হয়নি। ২০১০-২০১১ সালের দিকে ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়া শুরু হয়। মাল্টিমিডিয়া ফোন সবার হাতে হাতে পৌঁছে যায়। সেই সঙ্গে বলিউডে ‘আইটেম সং’ কালচার শুরু হয়। এই সময়েই মূলত পর্ন আসক্তি মহামারী আকার ধারণ করে ।

Dr. Victor B. Cline যে মডেল দিয়েছিলেন তার প্রথম ধাপে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ।

.

এই পুরোটা সময় জুড়ে পর্ন আসক্তরা যেমন মানসিকভাবে দিন দিন বিকৃত হয়েছে, নির্লজ্জ আর বেহায়া আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সেই সাথে পর্ণে দেখা জিনিসগুলো বাস্তবজীবনেও করতে গেছে। অর্থাৎ Dr. Victor B. Cline মডেলের ৩ এবং ৪ নম্বর ধাপে পা ফেলেছে।

.

২০১২-২০১৩-২০১৪ সালের সময়টাতে বাংলাদেশ পার করে ফেলে Dr. Victor B. Cline মডেলের ২ নম্বর ধাপটা। এন্ড্রয়েড ফোন এবং হাইস্পীড ইন্টারনেট একদম সহজলভ্য হয়ে ওঠে। ইন্টারনেট পৌঁছে যায় সবার হাতে হাতে। ‘আইটেম সং’ প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। নাটক, সিনেমা আরো অশ্লীল, আরো যৌন উত্তেজক হতে থাকে, প্রথম আলো একজন ‘বিশেষ পর্নস্টারের’ সংবাদ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ঘন ঘন ছাপাতে থাকে। বাঁধভাঙ্গা প্লাবণের মতো শিশু,কিশোর,তরুণদের ভাসিয়ে নেয় পরনোগ্রাফি।

কিন্ডারগার্ডেনের বাচ্চারাও পর্নমুভির খোঁজ পেয়ে যায়, ক্লাস থ্রি,ফোরের বাচ্চারাও হয়ে পড়ে পরনাসক্ত (অনেকের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এগুলো সত্যি। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে)

.

ডিসেন্টিসাইজড হওয়া শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু মহামারী আকারে ছড়িয়ে তখনই যখন পর্ন এবং আইটেম সং (বাই ডেফিনেশান আইটেম সং ও একধরণের পর্ন)দেখার পরিমাণ বেড়েছে। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের তথা সামগ্রিক সমাজের মানসিক বিকৃতি এবং অস্লীলতাকে স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়ার প্রবণতা ২০১৪-২০১৫ সাল থেকে চোখে লাগার মতো বৃদ্ধি পেয়েছে।

.

পর্ন দেখা এবং নারীদের নিয়ে 'ছিনিমিনি' খেলা পৌরষের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে যত নিচে নামতে পারবে, যার 'প্লে-বয়' ইমেজ যত বেশি সে তত বেশী আসল পুরুষ।

যারা নারীদেরকে আসলেই সম্মান করে, নারীর শরীরটা নয় বরং তার মনটাকেই যারা প্রাধান্য দেয়; তাদের নিয়ে চলে রসিকতা,ব্যঙ্গ,বিদ্রুপ; নপুংসক,হিজড়া ...।

.

পর্ন ফুয়েলড মিডিয়া প্লাস সমাজ মেয়েদের শিখিয়ে দিল কীভাবে পোশাক আশাক পড়লে কীভাবে চলাফেরা করলে তুমি যুগের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে পারবে, তুমি থাকবে সবার মনযোগ আর আকর্ষণের কেন্দ্রে। জিনস, টপস, টিশার্ট,আঁটসাঁট পোশাক আশাক উগ্র মেকাপ বেড়েছে। অভিভাবকেরা চোখ বন্ধ করে মেনে নিয়েছে মেয়েদের সন্ধ্যার পর ঘরে ফেরা, ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে মোটরসাইকেলে জড়াজড়ি করে ঘুরে বেড়ানো। রাস্তাঘাটের অশ্লীলতা সমাজ নীরবে মেনে নিয়েছে। স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে গ্রহণ করেছে।

.

সমাজের মানসিকতা এতোটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছে যে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে ‘আইটেম সং’ দেখতেও কারো বাঁধছেনা। ‘আইটেম গার্ল’, ‘পর্নস্টার’রা ঘরের মানুষ হয়ে গিয়েছে।

বাংলাদেশ বর্তমানে পা ফেলেছে Dr. Victor B. Cline মডেলের ৪ নম্বর স্টেজে- Acting Out.

গতকয়েক বছরে পর্নমুভির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ধর্ষণ বেড়েছে ব্যাপক আকারে। শিশু,কিশোর,তরুণ-তরুণীরা অল্পবয়সে লিটনের ফ্ল্যাটের খোঁজ করছে, ফার্মেসির ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছে, ডাস্টবিন থেকে হররোজ নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে, অন্তরঙ্গমুহূর্ত ভিডিও করে রাখা হচ্ছে, এই ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটে, ভুক্তভোগীরা ঝুলে পড়ছে সিলিংএ।

.

যৌনতার পদ্ধতি বদলে গেছে খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে। এনাল , সেক্সের,ওরাল সেক্সের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চিপায় চাপায়, আড়ালে আবডালে, এমনকি ক্লাসরুমেও ওরলা সেক্সে লিপ্ত হতে দ্বিধাবোধ করছেনা কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা। রিকশার হুডের নিচে, লোকাল বাসের পেছনের সিটে, রেস্টুরেন্ট আর সিনেমাহলের আলো আঁধারির ‘ক্লাসিক্যাল লুইচ্চামি’ তো রয়েছেই।

মাস্টারবেশনের পরিমাণ ভেঙ্গে ফেলেছে পূর্বের সকল রেকর্ড। যৌন অক্ষমতা, যৌন অতৃপ্তি, যৌন অসন্তুষ্টি বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরকীয়া,ব্যভিচার, পতিতাগমন,বিবাহ বিচ্ছেদ।

.

বাংলাদেশে পর্ন আসক্ত মানুষের সংখ্যা কোটি পার হয়ে যাওয়াও অস্মভব কিছুনা। প্রতিনিয়ত অজস্র নতুন মানুষ Dr. Victor B. Cline মডেলের প্রথম, দ্বিতীয়,তৃতীয় ধাপে পা ফেলছে।সবচেয়ে বেশী মানুষ বোধহয় রয়েছে তৃতীয় ধাপে; লক্ষ লক্ষ মানুষ মানসিকভাবে বিকৃত হয়ে গিয়েছে, বিকৃত যৌনচিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে অসংখ্য মানুষের মাথায়, সুযোগ পেলে এবং প্রাইভেসি পেলে এরা যেকোণ সময় যে কারো সাথেই বিছানায় চলে যাবে। এই মানুষ গুলো যখন তিন নম্বর ধাপ পেরিয়ে চার নম্বর ধাপে পা দিবে তখনকার কথা চিন্তা করলে রক্ত হিম হয়ে আসে।

.

গত তিন বছরের নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে এক জাহান্নামের দোরগোড়ায়। কিছু মানুষ নিজহাতে জাহান্নামের দরজা খুলে ঝাঁপ দিয়েছে আগুনে, অগণিত মানুষ ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। বর্তমান অবস্থার যদি উন্নতি না হয়, যদি পর্ন আসক্তির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন শুরু না হয়, যদি পর্ন আসক্ত হবার কারণ গুলো বন্ধ না করা হয়, তাহলে আগামী দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থা ধ্বসে পড়বে, পারিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে। প্রচলিত মূল্যবোধ, মহৎ রীতিনীতি, বিশ্বাস,শ্রদ্ধা,সম্মান,ভালোবাসা সব কিছুই বিলুপ্তির পথ ধরবে।

চলে যাবে সব কিছু নষ্টদের অধিকারে!

রেফারেন্সঃ

[১] https://en.wikipedia.org/wiki/Victor_Cline

[২] http://www.antipornography.org/sex_crimes.html