- Published on
কিছু পিছুটান ২
ব্রেকাপের কথা বলাতে সে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছে। এখন সে যদি আত্মহত্যা করে ফেলে আমি তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। তার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী- এই অপরাধবোধ আমাকে আজীবন তাড়া করে বেড়াবে। তাছাড়া আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে মামলা করলেও আমি তো পুলিশি ঝামেলায় ফেঁসে যাব। এখন কি করব?
এটাও বেশ কমন একটা সমস্যা। ব্রেকাপ করতে চাইলেই অনেকেই হুমকি দেয়। তুমি আমার সাথে রুম ডেইট করতে না গেলে আমি হাত কেটে ফেলব, ঘুমের ট্যাবলেট খাব আমাকে ছবি না দিলে , ছাদ থেকে লাফ মারব …এমন হুমকি দিতেও অহরহ শোনা যায়।
পাশাপাশি অভিমান করে ভাত খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া, কোনো বিশেষ আবদার পূরণের জন্য মদ গাজা সিগারেট খেয়ে টাল হয়ে পড়ে থাকা এগুলো তো ডাল্ভাতের মতো সাধারণ ঘটনা। এবং অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই ধংসাত্মক জিনিসগুলোকে ইতিবাচক দিক হিসেবে উপস্থাপন করা হয় আমাদের সমাজে। আহারে সে কতোটা পাগলের মতো ভালোবাসে … একদিন কথা না হলেই একটু অভিমান হলেই কেমন পাগলামি শুরু করে। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর কথা আসলে আত্মহত্যা করতে চায়! আহা কি গভীর প্রেম। প্রকৃত প্রেমিক একেবারে!
দেখো… সমাজ তোমাকে মিথ্যা বলে। এগুলো প্রেমের বা ভালোবাসার নমুনা নয়। এগুলো হলো তোমার পার্টনার যে নিপীড়ক (Abusive) মানসিকতার, তোমার পার্টনার তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তুমি কি করতে পারবে কি করতে পারবে না তা ঠিক করে দেয়, তোমার নাকে রশি বেঁধে গরু ছাগলের মতো ঘুরাতে চায় তার লক্ষণ। এগুলো ভালোবাসা নয়, প্রেম নয়। এগুলো হলো একজনকে দাস বানানোর অপচেষ্টা। তুমি তার দাসে পরিণত হচ্ছো।
অন্যের ভালোর জন্য, মঙ্গলের জন্য স্যাক্রিফাইস করা হলো কাউকে ভালোবাসার পূর্বশর্ত। তোমার সাথে প্রেম করা, রুম ডেইট করা , তোমার ছবি ভিডিও পাওয়া ইত্যাদি যে কারণেই এই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছে তোমার প্রেমিক বা প্রেমিকা … প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই দেখো এর মাধ্যমে সে আসলে তার নিজের স্বার্থ পূরণ করতে চাচ্ছে, তোমার মাধ্যমে তার নিজের কামনা বাসনা পূরণ করতে চাচ্ছে। খালি চোখে দেখলে আসলে মনে হয় যে তোমার ভালোবাসার জন্য সে হাত কাটছে, ঘুমের ট্যাবলেট খাচ্ছে বা নিজেকে শেষ করে দেবার হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো তার নিজের কামনা বাসনা পূরণ হচ্ছে না তোমাকে দেখতে পাচ্ছে না, তোমার সাথে কথা বলতে পারছে না এ জন্যেই সে এমন ধংসাত্মক কাজ করতে চাচ্ছে। এখানে তোমার প্রতি তাঁর ভালোবাসাটা গুরুত্বপূর্ণ নয় তার কাছে, তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো সে তোমার মাধ্যমে তার ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারছে না। তাই এমন করছে।
সে যদি আসলেই তোমাকে ভালোবাসতো তাহলে তোমাকে এভাবে মানসিক কষ্টের মধ্যে ফেলত না। তোমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করত না। তোমার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র এভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইত না।
এই আত্মহত্যার হুমকি দেওয়া বা বিভিন্ন ধংসাত্মক কাজ করা তার সাথে ব্রেকাপ করে ফেলার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে তোমাকে। তুমি যদি হুমকিগুলোর কারণে সম্পর্ক চালিয়ে যাও তাহলে সে শতোভাগ নিশ্চিত হয়ে যাবে তুমি তার দাসে পরিণত হয়েছ। তুমি তার হাতের মুঠোয় চলে এসেছো। তোমাকে দিয়ে যা খুশি তাই সে করিয়ে নেবে। তোমার জীবনের শতোভাগ নিয়ন্ত্রণ সে নিয়ে নেবে। বাকী জীবনটা তার দাস হয়ে চরম মানসিক নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়ে কাটাতে হবে তোমার।
দেখো, যারা এভাবে হুমকি দেয় তারা সাধারণত দেখা যায় তারা আত্মহত্যা করে না। আগেই বললাম এভাবে হুমকি দেবার মাধ্যমে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে চায়। এসব হুমকি ধামকি পাত্তা দিও না। ব্রেকাপ করে ফেলো।
তার সাথে একেবারে সকল ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দাও। ভুলেও কোনোভাবেই যোগাযোগ করবে না। তার বাবা মা বা বন্ধুবান্ধব তোমাকে অনুরোধ করতে পারে- ওর সঙ্গে প্লিজ একটু কথা বলো, তোমাকে ছাড়া সে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছে, সে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে, তুমি যদি একটু কথা বলতে তাহলে সে ভালো হয়ে যেত। তোমার পায়ে পড়ছি, ওর জন্য প্লিজ এই উপকারটুকু করো।
এটা আসলে এক ধরণের ফাঁদ। তুমি আজকে একটু কথা বলবে সে একটু ভালো হবে, পরশু তো তার আবার মন খারাপ হবে, পরশু তুমি আবার কথা বলবে? তরশু? তারপর দিন? তারপরের দিন? এভাবে যদি কথা বলতেই থাকো তাহলে তুমি তো হারাম রিলেশন থেকে বেরই হতে পারলে না। একটা লুপের মধ্যে আটকা পড়লে। ওর কথা মতোই তুমিই দিন পার করতে থাকলে। সেই তোমার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকল।
এছাড়া দেখ টানা কিছুদিন যোগাযোগ বন্ধ থাকলে ওর শোকের মাত্রা ধীরে ধীরে কমে যেত। চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল। কিন্তু তুমি এভাবে কিছুদিন পর পর যোগাযোগ করলে সে কখনোই তোমাকে ভোলার অবকাশ পাবে না। তার মস্তিষ্কে স্তিমিত হয়ে আসা তুমি আবার জেগে উঠছে। পুরোনো স্মৃতিগুলো আবার শক্তিশালী হয়ে যাচ্ছে। তার কষ্টের মাত্রাটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কাজেই তুমি এভাবে কথা বলে তাকে সাহায্য করতে চাইলেও আসলে তার ক্ষতি করছো। সম্পূর্ণভাবে তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দাও। যদি তার উপকার করতে চাও তাহলে তার পরিবারকে একজন মনোবিদ খুঁজে দাও [১]। মনোবিদের কাছে কয়েকটা সেশন কাটালে সে ঠিক হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ্।
তবে অনেকেই সত্যিকার অর্থেই আত্মহত্যা করতে চায়। তোমার প্রেমিক বা প্রেমিকা এমন হলে তুমি এক্ষেত্রেও ব্রেকাপ ছাড়া অন্য কিছু ভাববে না। বরং এক্ষেত্রে আরও গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত ব্রেকাপ করতে হবে। কারণ-
১) আত্মহত্যা করার প্রবণতা আছে বা সত্যিকার অর্থেই ইচ্ছা পোষণ করে এমন মানুষকে তোমার আমার মতো সাধারণ মানুষ কোনো সাহায্য করতে পারবে না। আত্মহত্যা করা থেকে ফেরাতে পারবে না। তার জন্য দরকার একজন প্রফেশোনাল মনোবিদের। তার প্রফেশনাল মেন্টাল সাপোর্ট দরকার। তোমাকে দরকার নেই। সে মানসিকভাবে অসুস্থ। মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় আছে। তুমি আত্মহত্যা থেকে বাঁচানোর জন্য তার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে গেলেও সে মানসিকভাবে সুস্থ হবে না। ভারসাম্য ফিরে পাবে না। বরং এই আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে তোমাকে সারাজীবন নির্যাতন নিপীড়ন করে যাবে।
২) জীবন ফুল বিছানো শয্যা নয়। জীবনে নানা ঝড় ঝঞ্জা আসেই । ছন্দপতন ঘটে। দুঃখ কষ্ট হতাশা, ব্যর্থতা গিলে ফেলতে চায় অজগর সাপের মতো। এটাই জীবন। মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিতে চাওয়া তার এই ভীরু দুর্বল কাপুরুষ মন জীবনের এই অন্ধকার দিনগুলোতে লড়াই করে টিকে থাকতে পারবে না। সে মাথানিচু করে পরাজয় বরণ করে পালাতে চাইবে জীবন থেকে। তুমি কেন এমন একজন মানুষকে জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী হিসেবে নেবে? সে তখন আত্মহত্যা করলে বা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলে তোমার বাচ্চা কাচ্চার, তোমার সংসারের কি হবে? তোমার নিজের কি হবে? ভেবেছো এসব?
আত্মহত্যা করা কবিরা গুনাহ। যে আল্লাহর নিষেধ লঙ্ঘন করে আত্মহত্যা করে, যে তার নিজের বাবা মার কথা না ভেবে তাদের ভালোবাসাকে পায়ে দলে আত্মহত্যা করে এমন ইমোশনাল, কাপুরুষের জন্য কেন তুমি নিজের জীবনকে নষ্ট করবে? যে আল্লাহর ভালোবাসার মূল্য দেয় না, যে তার বাবা মায়ের ভালোবাসার মূল্য দেয় না, সে তোমাকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসবে এমন কোনো গ্যারান্টি আছে?
কেন একজন মানসিকভাবে অসুস্থ , একজন রোগীর বোঝা তুমি বয়ে বেড়াবে? কেন তোমার জীবন নিয়ে জুয়া খেলবে? তোমার বাবা মা তোমার ভাই বোনকে কষ্ট দেবে? তুমি তো তাকে সুস্থ করেও তুলতে পারবে না। ভালোবাসা দিয়ে আমি তাকে ঠিক করে ফেলব এমন মিথ্যা আশ্বাস কেবল প্রকৃত সমস্যাটাই আড়াল করে রাখবে। সেও সুস্থ হবার, তার সমস্যা বোঝার সুযোগ পাবে না তুমিও তোমার এবং তোমার পরিবারকে শেষ করে দেবে।
তার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে গিয়ে পাপ না করে নিজের এবং তার ক্ষতি ডেকে না এনে ব্রেকাপ করে ফেলো। সম্ভব হলে তার পরিচত কাউকে তার মানসিক ভারসাম্যহীনতার কথা জানিয়ে দাও। তার বাবা মাকে বিষয়টি জানিয়ে কাউন্সেলিং করার জন্য বলো। ঝগড়া করো না। কোনো কটু কথা বলো না, রাগারাগি করো না- তুই মর, আত্মহত্যা কর, যা খুশি তাই কর জাহান্নামে যা , সুইসাইড করে ফেললে করেই ফেলতি এভাবে ন্যাকা কান্না কাদতি না- এ ধরণের আত্মহত্যার প্ররোচণামূলক কোনো কথা বলো না। মেসেজ দিও না। বিবেকের দিক থেকে এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের দিক থেকেও তুমি সেইফ সাইডে থাকবে। [2]
আত্মহত্যা করে ফেললেও তোমার নিজের অপরাধবোধে ভোগার কোনো কারণ নেই। তার মৃত্যুর জন্য কোনোভাবেই আই রিপিটি কোনোভাবেই তুমি দায়ী নও [৩]। মৃত্যু কষ্টদায়ক কিন্তু তাই বলে এমন ইমোশনাল, মানসিক ভারসাম্যহীন, কাপুরুষ একজন মানুষের জন্য প্রতিনিয়ত আফসোস করে তুমি তোমার নিজের জীবনকে নষ্ট করবে না। সে প্রেম করে মানে নিজেকে মানসিকভাবে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের কাজের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে তার নিজের উপর। তুমি তাকে আত্মহত্যা করতে বলো নি। তার বাবা মা বা সমাজ যদি তোমাকে দোষারোপ করে তাহলে তা হবে সম্পূর্ণরূপে অন্যায় ও সুস্পষ্ট জুলুম। বরং চাইলে তাদের দিকেই অভিযোগের আঙ্গুল তোলা যায় কিছুটা হলেও- কেন তাদের সন্তানের মানসিক অবস্থার ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখেনি। উপযুক্ত সময়ে ব্যবস্থা নেয় নি।
তুমি একটা পাপ থেকে বাঁচতে চাচ্ছো। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে চাচ্ছো। তাকে এবং তোমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে চাচ্ছো। কিন্তু সে আত্মহত্যা করেছে। এর দায়ভার সম্পূর্ণরূপে তার উপর। এতে তোমার কোনো পাপ নেই। আল্লাহ্ তোমাকে এজন্য পাকড়াও করবে না। [৪]
‘প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মের জন্য দায়ী থাকবে। কেউ অন্যের (পাপের) বোঝা বহন করবে না। [৫]