Published on

হৃদয়ের ঋণ (প্রথম কিস্তি)

বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম।

ছোটবেলা থেকেই খাম খেয়ালী ছিলাম।ভার্সিটিতে ওঠার পর খামখেয়ালীপনা আরো বেড়েছিল। খামখেয়ালীপনার তোড়ে জীবনটা হয়ে গিয়েছিল একেবারেই ছন্নছাড়া। প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্ট মোটামুটি হয়েছিল। পরের সেমিস্টারের রেজাল্ট খারাপ হল খুব।

ধাক্কা খেলাম একটা।

সমাজটাকে বদলে দেওয়ার কথা বলতো,মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেম গড়ার কথা বলতো এমন একটা সংগঠনে স্বেচ্ছাশ্রম দিতাম তখন। গাধার মতো খাটতাম, বাড়ি ফিরতে রাত হতো, প্রায় প্রতিদিন বাবা মার বকুনি খেতে হতো। দ্বিতীয় সেমিস্টার শেষে অবাক হয়ে দেখলাম ঘুনে ধরা সমাজ পরিবর্তনের কথা বলে যারা,তাদের অন্তরেই অনেক আগে ঘুন ধরেছে। মুক্তিযুদ্ধ এদের কাছে স্রেফ ব্যাবসার প্রোডাক্ট,আর কিছুনা।

ধাক্কা খেলাম আরেকটা।

তৃতীয় এবং শেষ ধাক্কাটা খেলাম প্রায় একই সময়ে । এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ধাক্কা। সে অনেক কথা, অন্য কোথাও অন্য একদিন বলব ইনশা আল্লাহ্‌।

এখন পেছনে ফিরে দেখলে,সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে অটোমেটিক বেশ বড়সড় একটা আলহামদুলিল্লাহ্‌ চলে আসে অন্তর থেকে। সেই সময়,সেই ধাক্কাগুলো আমার খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। সেই ধাক্কাগুলো না খেলে হয়তো আর প্রত্যাবর্তন করা হতো হতোনা আমার রবের দিকে। হেমন্ত আর মান্নাদে শুনে রুপালী আগুন ঝরা অসংখ্য নক্ষত্রের রাত কাটিয়ে দেওয়া আমার হয়তো কোনদিন সুযোগ হতোনা শেষ রাতে উঠে রবের সামনে নতমুখে দাঁড়ানোর।

সেই সন্ধ্যাটার কথা কোনদিন ভুলতে পারবোনা । জানুয়ারীর ৩ তারিখ ছিল বোধহয়। মাগরিবের সালাতের পর মসজিদে বসে ছিলাম একরাশ হতাশা নিয়ে। জীবনের হিসেব না মেলা ঘটনাগুলো একে একে আসছিল দুঃখের পসরা সাজিয়ে। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। হুট করে অন্তরের ভেতর থেকে কে জানি বললো,‘ ফিরে আয়, এখনো সময় আছে ফিরে আয় তোর রবের কাছে, আত্মসমর্পণ কর তোর রবের কাছে পরিপূর্ণভাবে। সিজদায় পড়ে গেলাম। তওবা করলাম। অশ্রুর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর জমাট বাঁধা দুঃখ কষ্টগুলোও বের হয়ে গেল। শান্তি পেলাম, অন্যরকম এক শান্তি,যার বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার।

জীবনটা সুস্থির হতে শুরু করলেও একাডেমিক লাইফ নিয়ে ছিলাম চরম হতাশায়। এই সময় আল্লাহ্‌ সাহায্য পাঠালেন রুমমেট দুইজনের মাধ্যমে। একরুমমেটের এক দুপুরে বলা অগোছালো কিছু কথাবার্তা আমার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনলো অনেকটাই। পরের তিনটা বছর প্রত্যেকটা পরীক্ষার আগে রুমমেট দুইজন আমাকে পড়া বুঝিয়ে দিত, নোট করে দিত। ক্লাসে শেষ বেঞ্চগুলোতে বসে আমি আরামসে ঘুম দিতাম বা গল্পের বই পড়তাম কারণ আমি জানতাম আমার রুমমেট মনযোগ দিয়ে ক্লাস করছে। পাস করা অনেক কষ্টকর হয়ে যেত আমার জন্য যদি আমার এই রুমমেট দুইজন না থাকতো। আল্লাহ্‌ আমাদেরকে জান্নাতেও একত্রিত করুক।

মানুষ যখন খুব বিপদে পড়ে,দুঃখ দুর্দশা,হতাশা আর গ্লানি যখন মানুষকে ঘিরে ধরে তখন একা একা তার পক্ষে লড়াই করে টিকে থাকা অসম্ভব রকমের কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তার ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন পড়ে কিছু হৃদয়ের ঋণের,দুটো সহানুভূতি আর উৎসাহের কথা,কিছু সান্ত্বনা, কিছু সাহস যোগানো মানুষের। একা একা মানুষের পক্ষে জীবনযুদ্ধ কতসময় ধরেই বা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? ইসলাম এইজন্যেই একা একা থাকার চেয়ে জামাআত বদ্ধ হয়ে থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। দলবদ্ধ হয়ে থাকলেই না শয়তানের বিরুদ্ধে এবং আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুলের (সাঃ) শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইটা জুতসই হবে।

আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশী ভুল বোঝা হয় বোধহয় পর্ন/মাস্টারবেশনে আসক্তদেরকে।এই ছেলেদের দুঃখ-কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাসগুলো এই সমাজ কোনদিন বোঝেনি,বোঝার চেষ্টাও করেনি। পর্ন/মাস্টারবেশন আসক্তির ভয়াবহতা অনুভব করতে পারেন না বেশীরভাগ মানুষই। এটা যে কি গভীর এক অসুখ, এই আসক্তি যে কোকেন বা হিরোইন আসক্তির মতোই ক্ষতিকর তা কয়জন মানুষ জানেন? কয়জন মানুষই’বা উপলব্ধি করতে পারেন একজন পর্ন/মাস্টারবেশনে আসক্ত ছেলের অবসাদ আর গ্লানির গভীরতা?

পর্ন/মাস্টারবেশন আসক্তি এই ছেলেগুলোর শরীর ভেঙ্গে চুরে দেয়, যৌন শক্তি ধ্বংস করে দেয়, আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দেয়,আত্মিক শূন্যতা সৃষ্টি করে,জীবন এদের কাছে নরকতুল্য মনে হয়, এই ছেলেগুলো নিজেদেরকে প্রচন্ড ঘৃণা করে। এদের অনেকের পক্ষেই একা একা সম্ভব হয়না পর্ন/মাস্টারবেশন আসক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার। প্রয়োজন হয় কিছু হৃদয়ের ঋণের। মানুষের সাহায্য সহযোগিতা,সহানুভূতির।

আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পর্ন/মাস্টারবেশন আসক্তি প্রবেশ করলেও এখন পর্যন্ত এই সমাজে এটাকে ট্যাবু করে রাখা হয়েছে। খোলাখুলি এটা নিয়ে তেমন কেউ কথা বলেনা, যারা কথা বলে অনেকসময়ই তাদেরকে একটু অন্য চোখে দেখা হয়, ঠাট্টা তামাশা করা হয়। একজন পর্নআসক্ত ছেলে সাহায্যের জন্য অন্য কারো কাছে যাবে,তার অন্ধকার,গোপন জগতের কষ্টগুলোর কথা কারো সঙ্গে শেয়ার করবে এটা এই সমাজের বাস্তবতায় খুবই কঠিন। এতোটাই কঠিন যে এরচেয়ে পর্ন আসক্তরা একা একা পর্নআসক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করাটা সুবিধাজনক মনে করে। অথচ একা একা লড়াই করে অন্য কারো সাহায্য না নিয়ে পর্ন/মাস্টারবেশন আসক্তি থেকে মুক্ত হয়েছে এমন নজির খুবই কম।

কোন গাঁজাখোর বা কোন বোতলবাজ যখন স্বেচ্ছায় তার পরিবারের কাছে যেয়ে বলে,‘আমি ভালো হয়ে যেতে চাই, এই নেশা ছাড়তে চাই’ তখন পরিবার,সমাজ তাকে খুব সাধুবাদ জানায়, হাজার হাজার টাকা খরচ করে তাকে কাউন্সেলিং করায়,মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যায়। অথচ পর্ন/মাস্টারবেশন আসক্তি এই নেশাগুলোর চেয়েও অনেক অনেকগুন ভয়ংকর। জীবন নিয়ে অতিষ্ঠ হবার পরেই কেবল একজন পর্ন আসক্ত ছেলে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে, শত দ্বিধাদ্বন্দে ভোগার পরেও পরিবার বা কাছের কোন মানুষের নিকট সাহায্যের জন্য যায়। যখন তার খুব বেশি প্রয়োজন হয় হৃদয়ের ঋন আর সহানুভূতির ঠিক তখন পরিবার,সমাজ তাকে দূরে ঠেলে দেয় । একনিমিষেই এই অসহায় ছেলেগুলোর পৃথিবীর সব রং নিভে যায়। বাবা মা ভাবেন, ‘ছি!ছি! আমার ছেলে কীভাবে এতোটা খারাপ হয়ে গেল!’ যেই সমাজের মানুষজন ‘গুডবয়’ ট্যাগ দিয়েছিল এই ছেলেদেরকে,সেই সমাজের মানুষজনের চোখেই এই ছেলেগুলো ‘লুইচ্চা’ হয়ে যায়।

এই সমাজে লুইচ্চামির ডেফিনেশানটা আলাদা। গভীর রাতে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ফোনালাপ লুইচ্চামি না, ফুটপাতে জাস্ট ফ্রেন্ডদের মধ্যে ঢলাঢলির সময় এই সমাজ চুপ করে থাকে;এইগুলা লুইচ্চামি না। ঈদ,পুজা,একুশে ফেব্রুয়ারী, সহ সব উৎসবের দিনকে ভ্যালেন্টাইন ডে বানিয়ে ফেলে লিটনের ফ্ল্যাটে যাওয়াও লুইচ্চামি না। এইগুলা বরং স্বাভাবিক। বয়সের দোষ।

পাপ থেকে দূরে সরে থাকার জন্য সাহায্য চাওয়াটা শুধু লুইচ্চামি!

হায়রে সমাজ!

হায়রে এই সমাজের মানুষ!

(আগামী পর্বে সমাপ্য ইনশা আল্লাহ্‌......)

পড়ুনঃ হৃদয়ের ঋণ (শেষ কিস্তি)- https://bit.ly/2NHUza4