Published on

ওর সাথে পালালাম - ১

পরপর বেশ অদ্ভূত কয়েকটা ঘটনা ঘটলো সেদিন। অল্প সময়ের ব্যবধানে। তবে ঘটনাগুলো থেকে কোনো উপসংহার টানার মতো বয়স ছিলো না আমার। বেশ ছোট ছিলাম, ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়ি কেবল।

নদীর ধারেই ছিল আমাদের স্কুল। হাইস্কুল, প্রাইমারি স্কুল পাশাপাশি। কমন মাঠ। মনে আছে সেদিন বাতাস হচ্ছিল ব্যাপক। একটা বাবলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম হাইস্কুলের মেয়েদের কমন রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে শিউলি আপা।[1] একটু উসখুস করছে। হঠাৎ করে মাটি ফুঁড়েই যেন উদয় হলো হাসান ভাই। আমাদের এলাকার স্ট্রাইক বোলার। সে সময়ের ক্রেজ শোয়েব আখতারের মতো বোলিং অ্যাকশান। প্রথম ওভারে একটা বোল্ড আউট করবেই করবে। হাসান ভাইকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। স্কুলে তার কাজ কী? সে তো স্কুল পাশ দিয়ে ফেলেছে!

হাসান ভাই শিউলি আপার দিকে এগিয়ে গেলো। ম্যাজিকের মতো শিউলি আপার হাতে একটা ট্রাভেল ব্যাগ বের হয়ে আসতে দেখলাম। হাসান ভাই ব্যাগটা নিয়ে একটা দৌড় দিলো। বল ছোড়ার আগে রানআপ নেবার সময় যে স্পিডে দৌড়াতো, তার চাইতেও বেশি জোরে। দেখলাম ব্যাগ নিয়ে সে দৌড়ে স্কুলের পেছনের রাস্তায় চলে গেল। সেখানে তার সাথে যোগ দিল আপন ভাই।

এরপর তারা কী করলো, কোথায় গেল, তা আর খেয়াল করিনি। স্কুলে একটা নতুন লাইব্রেরি হচ্ছে। সেটা নিয়েই বেশ উত্তেজিত ছিলাম আমরা। লাইব্রেরির আলোচনায় মজে গেলাম। একটু পর ক্লাসের ঘণ্টা পড়লো।

স্কুল ছুটির পর বাসায় ফিরে ভাত খাচ্ছি। আমি, আমার বোন, আম্মু। আকাশ কালো করে বৃষ্টি ঝরেছে ঘণ্টাখানেক। এখন বৃষ্টিটা ধরে আসলেও মাঝে মাঝে মেঘ গর্জন করে জানান দিচ্ছে–আরে আমি আছি, যাই নাই এখনো। দক্ষিণ দিকের দরজাটা খোলাই ছিল। সে দরজায় উদয় হলো ভীষণ দুঃখিত এক মূর্তি। মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব দুঃখ সিন্দাবাদের ভূতের মতো তার উপর এসে ভর করেছে।

‘আম্মাজান, আমার মেয়েটা কোথায়, বলতে পারিস? ওকে খুঁজে পাচ্ছি না’–বুক ফাটা আর্তনাদ করে আমার বোনকে প্রশ্ন করলো লোকটা।[2] আরে, এ যে বকুল কাকু! শিউলি আপার বাবা!

ভরদুপুর, কিন্তু মেঘ আর বৃষ্টির কারণে সন্ধ্যার মতো মনে হচ্ছে, বিদ্যুৎ চমকের আলো-আঁধারিতে আমাদের দরজায় দাঁড়ানো পৃথিবীর সব হারিয়ে ফেলা এক পিতা, তার অসহায় আর্তনাদ…এ দৃশ্যের কথা আমি ভুলতে পারি না। সেই ঘটনার পর বহু বছর পেরিয়ে গেছে। সময়ের প্রলেপে সব ক্ষতই সেরে উঠে। কিন্তু এই দৃশ্য, সেই বুক চেরা আর্তনাদের স্মৃতি এখনো বিষণ্ণতায় ভোগায় আমাকে। দম ফেলার সময় নেই এমন কর্মব্যস্ত দিনেও উদ্যমহীন করে ফেলে।

শিউলি আপাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুল থেকে বাসায় ফেরেনি। আলমারি থেকে জামা কাপড় সোনার গহনা সব মিসিং! আপন ভাইয়ের সাথে শিউলি আপার প্রেম ওপেন সিক্রেট। এটা পাড়ার যেকোনো ছাগলকে জিজ্ঞাসা করলেও কাঁঠাল পাতা চিবানোর ফাঁকে ফাঁকে সে বিস্তারিত সব বলে দিতে পারবে! কাজেই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানো কোনো কঠিন কাজ ছিল না।

আম্মু আর আপুর পরামর্শে আমাদের বাসার কাছেই শিউলি আপার অন্য এক বান্ধবী টিনা আপার বাসায় গেল বকুল কাকু। তার পিছু পিছু গেল হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা কাকী।

পরে জেনেছিলাম সেই বাসাতেই লুকিয়েছিল শিউলি আপা। টিনা আপা আর তার পরিবার বকুল কাকুকে মিথ্যা বলে। সেখানেও খুঁজে না পেয়ে বকুল কাকু পাগলের মতো হয়ে যায়। বুক চাপড়ে কান্না করতে করতে এর ওর বাড়িতে খুঁজতে থাকে।

মেয়েকে হারানোর ভয়ে ভীত বকুল কাকুকে যখন টিনা আপা ভূগোল বোঝাচ্ছিল, তখন ধানের গোলায় লুকানো শিউলি আপা সব শুনছিল, উঁকি মেরে দেখছিলও। বুঝতে শেখার পরে অনেকবার মনে হয়েছিল শিউলি আপাকে একবার প্রশ্ন করি–বাবার এমন অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা দেখার পরেও আপনার মনে এতোটুকুও দয়া হলো না? একবার মনে হলো না, বের হয়ে বাবার হাত ধরে বলি–বাবা ভুল হয়ে গেছে, চলো বাড়ি চলো! বাবার এতো ভালোবাসা, এতো মায়া, এতো মমতার কি কোনো দাম নেই? প্রেম কি এতোটাই অন্ধ?


[1] ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য সবার নাম বদলে দেওয়া হলো। বাকি ঘটনা সত্য।

[2] শিউলি আপা আর আমার বোন একই ক্লাসে পড়তো।