Published on

সখী ভালোবাসা কারে কয়? (১)

ধরো, ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে ক্লাস শেষে ফিরছিলে ঘরে। মন এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত। হঠাৎ রাস্তার অপর পাশের ফুটপাতের একটা দৃশ্য দেখে কৌতূহলী হয়ে গেলে। মাথায় সবুজ ওড়না দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল এক অষ্টাদশী। বৃদ্ধা এক ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইলো তার কাছে। স্নিগ্ধ একটা হাসি ফুটে উঠলো অষ্টাদশীর মুখে। কিন্তু অতলান্ত দুই চোখে বেদনার, সহানুভূতির ছাপ স্পষ্ট। পার্স থেকে ১০ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলো বৃদ্ধার দিকে। তার সবুজ ওড়না, হাসি, তাকানো, অসহায় মানুষকে সাহায্য করা সবকিছু মুগ্ধ করলো তোমাকে। তুমি ভাবলে–হ্যাঁ, একেই তো আমি খুঁজছিলাম এতোদিন! সে-ই আমার জন্য একদম পারফেক্ট। তোমার এই অবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়–Love at first Sight বলে। প্রথম দেখায় প্রেম। কিন্তু এটাই কি ভালোবাসা?

রবি ঠাকুর বহু বছর আগে প্রশ্ন করেছিল ভালোবাসা কাকে বলে? প্রশ্নটা এখনো প্রাসঙ্গিক। চারদিক আজ ভালোবাসায় সয়লাব। ভালোবাসার বাম্পার ফলনে এমন অবস্থা যে রাস্তাঘাটে বিশেষ দিবসগুলোতে চোখ তুলে তাকানো যায় না। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো প্রেম না করলে, ভালোবাসার একটা মানুষ না থাকলে অন্যদের ক্ষ্যাত, ব্যাকডেইটেড মনে করা এই আমরা আসলে ভালোবাসার সংজ্ঞাটাই জানি না!

এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। সিনেমা, নাটক, সাহিত্য, মিডিয়ার ব্রেইনওয়াশিং আছে, নষ্ট সভ্যতার নষ্ট দর্শনের প্রভাব আছে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের লাভক্ষতির হিসেব আছে, সুশীল-প্রগতিশীল গোষ্ঠী, এককথায় সাংস্কৃতিক জমিদারদের ধোঁকাবাজি আছে, আছে ভাষার সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ। ঘটা করে ভালোবাসা দিবস পালন করলেও, প্রেমের জয়গান গাইলেও আদর্শিক অবস্থানের কারণে সাংস্কৃতিক জমিদাররা তোমাকে শেখাবে না ভালোবাসার সংজ্ঞা। তোমরা যে প্রেম করছো, জীবন দিয়ে দিচ্ছো, ক্যারিয়ার নষ্ট করছো, পরিবার, সমাজ ও জাতির বোঝা হচ্ছো–সরি টু সে, সেগুলো ভালোবাসা না। সেগুলো স্রেফ মোহ বা দৈহিক আকর্ষণ (lust-কামনা)। যদি তোমরা জানতে, যেই ছেলেগুলো প্রেমাতাল হয়ে জীবন নষ্ট করছে, যেই মেয়েগুলো ভালোবাসার প্রমাণ দেবার জন্য বরিশালের লঞ্চের কেবিনে উঠছে–তারা যদি জানতো, তাহলে এভাবে তারুণ্যের অপচয় হতো না, এভাবে বিষাদ সাগরে হাবুডুবু খেতো না পুরো একটা প্রজন্ম, ডুবতে থাকতো না পুরো একটা জাতি। পুরো একটা সভ্যতা!

ভালোবাসার সাথে যে দুইটি জিনিস সবচেয়ে বেশি গুলিয়ে ফেলা হয় তা হলো মোহ (infatuation) এবং কামনা (lust)। বাঁচতে হলে ভালোবাসা, মোহ এবং কামনা/দৈহিক আকর্ষণ–এই তিনটি বিষয় অত্যন্ত ভালোমতো বুঝতে হবে। তাহলে এসো দেখে নেওয়া যাক, এই বিষয়গুলোর মধ্যে পার্থক্যগুলো কী কী।[1]

মোহ: ড. লরেন ফৌগল মারসি একজন মনোবিজ্ঞানী এবং সেক্স থেরাপিস্ট। তার মতে মোহ হলো–কাউকে ভালোমতো না জেনেই তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ, মুগ্ধতার অনুভূতি। এই অনুভূতি খুবই তীব্র হয়। কিন্তু এর পুরোটাই শারীরিক আকর্ষণ এবং সেই ব্যক্তিকে নিয়ে নিজের করা কাল্পনিক ফ্যান্টাসির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে।

গ্রেইস সা, একজন লাইসেন্সড হেলথ কাউন্সেলর। তার মতে, কোনো একজন ব্যক্তির সাথে দেখা হবার পর খুব দ্রুতই মোহ তৈরি হয়ে যেতে পারে। প্রথমবারের মতো দেখা হয়েছে, কিন্তু মনে হতে পারে–যাক, অবশেষে আমি তাকে খুঁজে পেলাম।[2] কারো শরীর, চুল, চোখ, হাসি, কোনো নির্দিষ্ট আচার-আচরণ, কথাবার্তার স্টাইল, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, চেহারা...যেকোনো কিছু দেখেই মানুষ একদম নিমিষেই, প্রথম দেখাতেই তার মোহে পড়ে যেতে পারে।

মোহের তীব্রতা বেশি হলেও এটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এবং রঙ্গমঞ্চে অন্য মানুষ চলে আসলে আগেরজনকে বাদ দিয়ে মোহের অনুভূতিগুলো তার দিকে চলে যায়। মোহের এই তীব্র অনুভূতির কারণে অনেকেই এটাকে ভালোবাসার সাথে গুলিয়ে ফেলে। মোহে হাবুডুবু খেয়ে ভাবে, আমি তাকে ভালোবাসি।[3]

বিশেষজ্ঞদের মতে মোহের কিছু লক্ষণ -

১। তুমি সবসময় তার কথা ভাবো। তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ো।

২। তার সাথে বাস্তবে তেমন কোনো ইন্টার‍্যাকশন হয়নি। কথাবার্তাও তেমন হয়নি।

৩। তুমি মনে করো রূপেগুণে, চরিত্রে সে একদম পারফেক্ট একজন মানুষ।

৪। তুমি মনে করো সে তোমার জন্য একদম পারফেক্ট ম্যাচ, তোমার আদর্শ জীবনসাথী।

৫। তার প্রতি তীব্র শারীরিক আকর্ষণ বোধ করো। এই দৈহিক আকর্ষণের কারণে তুমি তার সম্পর্কে অন্য জিনিসগুলো (তার ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, গুণ) জানার ব্যাপারে মনোযোগ দিতে পারো না। বা দাও না।

৬। তার পাবলিক জীবন সম্পর্কে টুকটাক কিছু জানলেও ব্যক্তিগত জীবনে সে কেমন, তা নিয়ে তোমার তেমন কোনো জানাশোনা নেই। তুমি যা জানো তার বেশিরভাগই তার পোশাক-আশাক, মানুষের সঙ্গে তার আচরণ ইত্যাদি দেখে ধারণা করা। আর যেগুলো জানো সেগুলোও বিশেষ কিছু না।

৭। দূর থেকে দেখে তুমি তাকে নিয়ে ফ্যান্টাসি করো, তার সাথে কোথায় ঘুরতে যাবে, কীভাবে সময় কাটাবে ইত্যাদি।

৮। যদি সে তোমার প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারে তাহলে তুমি একটু অসন্তুষ্ট হও।

৯। তার ভুল ত্রুটি কোনো কিছু কেউ দেখিয়ে দিলেও তুমি সেগুলোকে পাত্তা দাও না, কারণ সেগুলো তাকে নিয়ে তোমার ফ্যান্টাসির সাথে যায় না।

১০। তাকে মুগ্ধ করার জন্য তোমার চেষ্টার কোনো কমতি থাকে না।

১১। তার প্রতি তুমি খুবই দ্রুত দুর্বল হয়ে যাবে। অনুভূতি হবে অত্যন্ত তীব্র। তুমি সবসময় তার সাথে সময় কাটাতে চাও। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, কাজকর্মের ভয়ংকর ক্ষতি হলেও কুছ পরোয়া নেহি!

১২। সবকিছু অত্যন্ত দ্রুতগতিতে হবে। তুমি অস্থিরতায় ভুগবে। ঠিকমতো খেতে পারবে না, ঘুমাতে পারবে না। কোন কাজ করতে পারবে না। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তুমি রিলেশনশিপের চূড়ান্ত রূপ দেখতে চাইবে।[4]


[1] এ অংশের আলোচনাটা সাজানো হয়েছে বিভিন্ন সেক্যুলার বিশেষজ্ঞদের গবেষণার আলোকে। নারীপুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারে সেক্যুলার চিন্তা এবং ইসলামের অবস্থানের মধ্যে মৌলিক বেশ কিছু পার্থক্য আছে, যে কারণে তাদের সব অবস্থানের সাথে আমরা একমত না, তবে মোটাদাগে প্রাথমিক কিছু ধারণা এখান থেকে নেওয়া যেতে পারে। সেক্যুলার আর ইসলামী অবস্থানের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা আসছে একটু পরেই।

[2] Infatuation vs. Love: How To Tell If You're Just Infatuated, mindbodygreen.com, - tinyurl.com/3dcppky8

[3] The Chemistry of Love, howstuffworks.com– tinyurl.com/ymct7hhf

Zou et al., (2016). Romantic love vs. drug addiction may inspire a new treatment for addiction. Frontiers in psychology, 1436

How to tell the difference between lust and love, Insider, Jan 27, 2021- tinyurl.com/4xs9hnnt

[4] Infatuation vs. Love - tinyurl.com/3dcppky8

8 Ways To Tell The Difference Between Love & Lust, amp.mindbodygreen.com February 21, 2021- tinyurl.com/44avyuvw