Published on

কেন এই বই? (শেষ পর্ব)

কেন এই বই? (৩)
বইঃ আকাশের ওপারে আকাশ
---------------
এ অবস্থার জন্য শুধু ওদের দায়ী করা যায় না। শুধু ওদের দায়ী করা অপরাধ। এ অবস্থার জন্য দায়ী আমাদের পচে যাওয়া সমাজ, কামনাবাসনা ক্রমাগত উস্কে দেওয়া মিডিয়া আর বিনোদন জগৎ, সীমালঙ্ঘনের অজুহাত তৈরি করা বুদ্ধিজীবি, রাষ্ট্র নামের অতিকায় যুলুমযন্ত্র, পুঁজি আর প্রফিটের ক্যালকুলাস, সস্তা সুখ আর সাময়িক আরামকে সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে ফেলার মনস্ত্বত্ত্ব, আর জীবন থেকে আসমানী নৈতিকতাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার সবক দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থা।
.
এ অবস্থার জন্য দায়ী নষ্ট সভ্যতার নষ্ট বিশ্বকাঠামো।
.
সবাই মিলে এক নিপুণ ষড়যন্ত্রে যিনা-ব্যভিচারের উপর চাপিয়ে দিয়েছে ‘পবিত্র প্রেম’-এর পোশাক, গুণকীর্তন করে চলেছে বছরের পর বছর। রোমান্টিকতার প্রলেপ জড়িয়েছে পরতের পর পরত। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের সমাজের কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে অভিভাবকদের মধ্যেও যে ন্যারেটিভ দাঁড় হয়ে গেছে তা হচ্ছে -

১। প্রেম করতেই হবে। বিশেষ করে তারুণ্যে।

২। সফলতার মাপকাঠি হল যৌনতা, অর্থ, খ্যাতি, ক্ষমতা এবং জীবনযাত্রার মান। যার কাছে এগুলো যতো বেশি আছে তার জীবন ততো বেশি সফল, ততো বেশি পরিপূর্ণ।

৩। ইনবক্সে ফ্লার্ট করা, ভিডিও কলে কাপড় খোলা, বৃষ্টি বিলাস, হুড তোলা রিকশা বিলাস, অন্ধকারে রেস্টুরেন্ট বিলাস আর লিটনের ফ্ল্যাটে শরীরের উত্তাপ মাপা--সবই এখন পবিত্র প্রেমের অংশ। আর প্রেম এই বয়সের স্বাভাবিক ধর্ম। যারা এগুলো করে না তারা সেকেলে, আধুনিকতার মাঝে বেমানান। তারা গান্ধা, ক্ষ্যাত। তারা একেকটা লুযার। এমন ছেলেরা আসল পুরুষ নয়। এমন মেয়েদের কেউ চায় না। তাদের জীবনে সুখ, আনন্দ বলে কিছু নেই। জীবনের রঙ-রূপ-রস-গন্ধ তারা কিছুই পায়নি। তাদের জীবন হলো ষাট সত্তর দশকের সাদাকালো ঝিরঝির কষ্টের সিনেমার মতো। আর প্রেমাতাল জীবন হলো আইটেম সং আর মালমশলায় ভরা হাউসফুল রঙিন সিনেমা, মারভেলের সুপারহিরো সিনেমা, কিংবা নেটফ্লিক্সের 8k স্ট্রিমিং। খালি সুখ, মজা আর এক্সাইটমেন্ট।
.
বিশ্বকাঠামোর দ্বারা প্রচণ্ডভাবে ব্রেইনওয়াশ হবার ফলে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষেরা যেমন বিয়ে বহির্ভূত প্রেম, যিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে গেছে, তেমনি এই জঘন্য অপরাধের ব্যাপারে সমাজের মানুষগুলোর মনেও তৈরি হয়ে গেছে একটা গ্রহণযোগ্যতা।
.
তাই আজ রাস্তায়, পার্কে, রিকশায়, ফেইসবুক-টিকটকে জড়াজড়ি, চুমাচুমি কিংবা অন্য কোনোভাবে সবার সামনে শরীরের ওম ভাগাভাগি করলেও মানুষজন উপেক্ষা করে চলে যায়। মফস্বলের কোনো মুরুব্বি চাচাকে এখন আর দেখা যায় না ‘হলের এক টিকিটের দুই ছবি: যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়’ টাইপের প্রতিবাদী মতামত লিখে পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় পাঠাতে কিংবা ফেইসবুকে পোস্ট দিতে। সবাই কেন জানি সবকিছুকে মেনে নিয়েছে। সবাই কেমন যেন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এখানে কোনো হইচই নেই। পরিবেশটা একদম শান্ত!
অথচ হাজার বছরের ইতিহাস বারবার সাক্ষ্য দেয় অবাধ যৌনতার প্রসার সমাজ ও সভ্যতাকে ধ্বংস করে। তা সেটা প্রেম, ভালোবাসা, রিলেশনশিপ কিংবা অন্য যেকোনো নামেই হোক না কেন। আজ প্রেম, ভালোবাসা আর ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে যৌনতার বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। .
.
ফলে যা হবার তাই হয়েছে। চারিদিকে আজ শুধু ভাঙনের সুর। হতাশা, মাদকাসক্তি, আত্মহত্যা, যিনা-ব্যভিচার, খুন, ধর্ষণ, ডাস্টবিনে নবজাতকের লাশ, পরকীয়া, বিচ্ছেদ...সমকামীদের রঙধনু মিছিল! নারীপুরুষ নিজের পরিচয় সম্পর্কে ভুগছে অবিশ্বাস্য বিভ্রান্তিতে। এই তীব্র অসুখগুলোকে বলা হচ্ছে স্বাধীনতা আর ক্ষমতায়ন। যৌন মানসিক বিকৃতির প্রচারক, প্রসারকদের উপস্থাপন করা হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্ক আর মহান বুদ্ধিজীবী হিসেবে। আজ পতনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে প্রতিনিয়ত!
.
উচ্ছৃঙ্খল স্রোতে গা ভাসানো কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের অনেকে এক সময় থমকে দাঁড়ায়। পিচ্ছিল এই অন্ধকার স্রোত থেকে ফিরে আসতে চায়। কেন তাদের জীবনে এতো হতাশা, এতো অশান্তি, আত্মহত্যার প্রবণতা–এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে চায়। কিন্তু প্রশ্নের সঠিক উত্তর মেলে না। উল্টো সবক দেওয়া হয়–প্রেম করলে, সেক্স করতে পারলে, আরো টাকা কামালে, তোমার জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যেই প্রেম, যিনা-ব্যভিচার, ভোগের যে অন্ধ নেশা–তাদের জীবনের বারোটা বাজিয়েছে, তাকেই আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে বলা হয় ওদেরকে। ওরাও তাই করে। আরো ক্ষতবিক্ষত হয়। কেউ কেউ বুঝতে পারে, চিনতে পারে আসল সমস্যা। কিন্তু অন্ধকার এই জগৎটা থেকে বের হয়ে আসার উপায় খুঁজে পায় না। অভিভাবকরা কিংবা সমাজ হয়তো তাদের সাহায্য করতে পারতেন। কিন্তু তারাও ব্রেইনওয়াশড হয়ে গেছেন। তাদের মূল মনোযোগ এখন ছেলেমেয়েকে কীভাবে বিসিএস ক্যাডার বানানো যায়, অথবা বিদেশে সেটেল করানো যায়–তার দিকে।
***
কিশোর, তরুণ থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী, প্রৌঢ় অভিভাবক সকলের অবস্থার কথা চিন্তা করেই এই বই সাজানো হয়েছে। এই জেনারেশনের এতো হতাশা, আত্মহত্যা, এতো দুঃসময়ের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি আমরা। প্রেম ভালোবাসার রঙিন বায়োস্কোপের পেছনের যে গল্পগুলো কেউ দেখাতে চায় না, আমরা সেই দুনিয়া দেখানোর চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি সেই দুনিয়া থেকে বের হয়ে আসার পথ চিনিয়ে দেবার। সেই দুনিয়াকে চিরতরে শেষ করে দেবার জন্য অভিভাবক, সমাজ, রাষ্ট্র সবার ভূমিকা কী হতে পারে, সংক্ষিপ্ত আকারে তা-ও আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে।
.
রেফারেন্স, তথ্যপ্রমাণ ইত্যাদির জন্য বিশুদ্ধ উৎসগুলোর উপর নির্ভর করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। তবু ভুলত্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আশা করি, আমাদের ভুলত্রুটিগুলো পাঠকরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। আমাদের লেখাগুলোর নিয়মিত আপডেট পেতে চোখ রাখতে পারেন এই ফেসবুক পেইজে এবং ওয়েবসাইটে:
www.facebook.com/lostmodesty
www.lostmodesty.com
www.youtube.com/lostmodesty
https://t.me/lostmodesty
.
এই বইয়ের সংগে অসংখ্য মানুষের শ্রম, ঘাম আর আত্মত্যাগ জড়িত। বহু মানুষ অভিজ্ঞতা শেয়ার করে, লেখা দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে, বইয়ের কাজ কতোদূর বারবার জিজ্ঞাসা করে, ঝাড়ি মেরে...চিরকৃতজ্ঞতার বাঁধনে জড়িয়ে নিয়েছেন আমাদের। তাঁদের প্রতিদান দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই। আল্লাহর কাছে বিনীত নিবেদন এই সাহায্যের বিনিময়ে আল্লাহ যেন তাঁদেরকে ক্ষমা করে দেন। সেই সঙ্গে এই বইয়ের উসীলায় আল্লাহ যেন আমাদেরকে কবুল করে নেন।
.
বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার প্রতিটি উপাদান যখন বিবাহ বহির্ভূত প্রেম-ভালোবাসা, যিনা-ব্যভিচারকে মহিমান্বিত করে চলেছে সকল শক্তি বিনিয়োগ করে, তখন আমাদের মতো অতি ক্ষুদ্র, নগণ্য, দুর্বল কয়েকজন যুবক আর কী করতে পারে! তবুও আমরা বিশ্বাস রাখি ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে দেওয়া আল্লাহর প্রতিশ্রুতির উপর। জনবিরল মরুভূমিতে দাঁড়ানো ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ বলেছিলেন আযান দাও। আযান পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আযান দিলেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি আনাচ-কানাচ থেকে, বহু জনপদ, সাগর, পাহাড় পাড়ি দিয়ে কোটি কোটি মানুষ কিয়ামত পর্যন্ত ছুটে চলবে সেই মরুর বুকের মক্কায়। আমরাও সেই আল্লাহর উপরই ভরসা করে আযান দিলাম…
.
লস্ট মডেস্টি
১১.০৯.২০২২