Published on

কিছু পিছুটান-৪

আমি তার সাথে জেনা করে ফেলেছি, তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এমন অবস্থায় ব্রেকাপ করলে তা তার সাথে ভয়ঙ্কর প্রতারণা হবে না? তাছাড়া, তাকে বিয়ে করলে তো আমার জেনার গুনাহ মাফ পেয়ে যেত।

বাংলাদেশে সাধারণত এমন একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে- যার সাথে জেনা করা হয়েছে তার সাথে বিয়ে দিলেই আল্লাহ্‌ জেনার গুনাহ মাফ করে দিবেন। কিন্তু শরীয়ার বাস্তবতা এটা নয়।

দেখ জেনা বেশ ভয়ঙ্কর একটা গুনাহ। কেউ এমন কাজ করলে আর যদি অবিবাহিত হয়, তার জন্য শরীয়া আইনের নির্ধারিত শাস্তি হলো ১০০ বার বেত্রাঘাত ও ১ বছরের জন্য নির্বাসন। যার সাথে জেনা করেছে তাকে বিয়ে করা নয়।

আল্লাহ্‌ বলছেন, “ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী উভয়কে এক’শ ঘা করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকরী করবে এদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের অভিভূত না করে। যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হয়ে থাক। ঈমানদারদের একটি দল যেন এদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।”[1]

জিনা করার সময় মানুষ আসলে ঈমান হারিয়ে ফেলে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “কোন ব্যক্তি যখন ব্যভিচার করে তখন তার ভেতর থেকে ঈমান বেরিয়ে যায়, এরপর তা তার মাথার উপর ছায়ার মত অবস্থান করতে থাকে। এরপর সে যখন তা থেকে তওবা করে তখন তার ঈমান পুনরায় তার কাছে ফিরে আসে”। [2]

এজন্য তওবা করতেই হবে। এখন তাওবা করতে বলতে আমরা কী বুঝি? বাবার পকেট কাটতে গিয়ে ধরা পড়লাম। কাঁচুমাচু করে বাবাকে বললাম- বাবা, মাফ করে দাও আর করব না কখনো। কিন্তু মনে মনে ঠিকই জানি যে এবারের মতো মাফ পেলে আবার প্রথম সুযোগেই আমি পকেট কাটব।

আমাদের তাওবাহর অবস্থা যদি হয় এমন তাহলে সেটা তাওবাহ হবে না। জিনা করলাম। জিনা করার আগে বা জিনারত অবস্থায় ভাবলাম তাওবাহ করে নিব। এরপর জিনা করে আল্লাহর কাছে তাওবাহ করলাম আল্লাহ্‌ আমি আর কখনো জিনা করব না। এমন হলে সেটা তাওবাহ করা হবে না। বরং তা হবে আল্লাহর সাথে রসিকতা।

তাওবাহ করার শর্ত আছে ৩ টি।

১) সেই গুনাহ এবং গুনাহের উপকরণগুলো ছেড়ে দেওয়া

২) আন্তরিকভাবে লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা , মাফ চাওয়া

৩) ভবিষ্যতে এমন গুনাহ আর কখনোই করব না- কঠোরভাবে এই সংকল্প করা।

এই ৩ টি শর্ত পূর্ণ করতে পারলে তোমার তাওবাহ কবুল হবে। না হলে হবে না। এই যে আন্তরিকভাবে লজ্জিত হওয়া, অনুতপ্ত হওয়া এটা আবার কেমন হবে? মানে এটার মাত্রা কেমন হবে?

আমরা তওবা করতে বুঝি আল্লাহ্‌র কাছে মাফ চেয়ে নিলাম- আল্লাহ্‌ আমাকে মাফ করে দিও, কিছু দান খয়রাত করলাম ব্যস খেল খতম। এমনটা করলে হবে না।

এক বইয়ে খুব সুন্দর উদাহরণ পড়েছিলাম আন্তরিকভাবে তাওবাহ করার উপরে। তাওবাহর আন্তরিকতা বোঝাতে গিয়ে লেখক উদাহরণ টানছেন এক মায়ের কথা। মা রান্না ঘরে কাজ করছেন। ২ বছরের দুষ্টু বাবুটা ড্রয়িঙ রুমের ফ্লোরে বসে খেলছে। মা কাজের ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে দেখে আসছে বাবুটাকে। খোকার বাবার প্রিয় তরকারি ট্যাংরা মাছের ঝোল। সেটা মন দিয়ে রাধতে গিয়ে খোকার কথা আর খেয়াল নেই। খেয়াল যখন হলো তখন মা দৌড়ে গেলেন ড্রয়িং রুমে। কিন্তু খোকা সেখানে নেই। আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মায়ের মাথায়। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে, অনেক ডেকে ডেকেও খোকাকে পাওয়া গেল না। মা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। মাথাতে একটু পানি দিতে বাথরুমে গিয়ে খোকাকে পেলেন। তবে খোকা আর বেঁচে নেই। বালতির পানিতে ডুবে মারা গেছে।

এই মা যে শোকটা পেলেন সেটা তিনি আর সারাজীবন ভুলতে পারবেন না। ট্যাংরা মাছের ঝোল রান্না করায় হয়ত তিনি বাদ দিবেন। আর বহুদিন পর, ২০/২৫ বছর পরেও ট্যাংরা মাছ দেখলে বা বালতি পানি জমানোর সময় তার মনে হবে খোকার কথা। বুকটা ছ্যাত করে উঠবে। তোমার আমার তাওবাহ হতে হবে এমন। মনে হবার সাথে সাথেই বুকটা ছ্যাত করে উঠবে। ইয়া আল্লাহ্‌ কি জঘন্য কাজটাই না আমি করেছিলাম!

তওবা যেন কবুল হয় সে জন্য বেশি বেশি গোপনে দান করা উচিত, গোপনে ইবাদত করা উচিত। এগুলো আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ মিটিয়ে দেয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,“আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডাকে না এবং যারা আল্লাহ যে প্রাণকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর যারা ব্যভিচার করে না। আর যে তা করবে সে আযাবপ্রাপ্ত হবে। কিয়ামাত দিবসে তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সেখানে সে স্থায়ী হবে হীন অবস্থায়।

তবে-

তারা নয় যারা তওবা করবে, ঈমান আনবে, আর সৎ কাজ করবে। আল্লাহ এদের পাপগুলোকে পুণ্যে পরিবর্তিত করে দেবেন; আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু। যে ব্যক্তি তওবা করে ও সৎ কাজ করে সে সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহর অভিমুখী হয়।” [3]

আন্তরিকভাবে তাওবাহ করলে আল্লাহ্‌ তোমাকে মাফ করে দিবেন জিনার শাস্তি থেকে ব্যাস।কাজেই যার সাথে জিনা করেছে তাকে তুমি বিয়ে করতে বাধ্য গুনাহ মাফের জন্য এটা ভুল ধারণা।

এখন আসো প্রতারণার ব্যাপারে…

জিনার গুনাহ অতি জঘন্য হওয়ার কারণে আল্লাহ তাআলা জিনাকারী নারী-পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া হারাম করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “ব্যভিচারী কেবল ব্যভিচারিণী অথবা মুশরিক নারীকে ছাড়া বিয়ে করবে না এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক ছাড়া বিয়ে করবে না। আর মুমিনদের উপর এটা হারাম করা হয়েছে।” [4]

প্রথমে আয়াতটা শুনতে একটু অদ্ভুত লাগতে পারে। কথাটার মানে কী? ব্যভিচারী কেবল ব্যভিচারিণী আর মুশরিকক নারীকেই বিয়ে করে? শায়খ সাদী (রহ) তার তাফসীরে সুন্দর করে এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। যে জানা সত্ত্বেও কোন তওবা না করা ব্যভিচারিণীকে বিয়ে করতে চায় তবে তার ব্যাপারে কেবল দুটি কথাই খাটে-

১। হয় সে নিজে ব্যভিচারী তাই আরেকজন ব্যভিচারিণী বিয়ে করতে তার সমস্যা হচ্ছে না। রুচিতে বাধছে না।

২। কিংবা সে হয়তো ব্যভিচারী না। কিন্তু সে আসলে হালাল-হারামের তোয়াক্কা করে না। আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল (সা) যে বিধান দিয়েছেন তা নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। যার অর্থ, সে অবশ্যই একজন মুশরিক। [5]

এটা কোনো ব্যভিচারী পুরুষের ব্যাপারে যেমন খাটে, ব্যভিচারিণী নারীর ব্যাপারেও খাটে। তাই যদি নিজে তওবা করার সাথে সাথে যদি অপরজনও তওবা না করে, তবে বিয়ে বৈধ হবে না। এবং তুমি আন্তরিকভাবে তাওবাহ করেছ কিন্তু সে করেনি এমন অবস্থায় তুমি তাকে বিয়ে না করলে প্রতারণা হবে না। তবে সেও যদি আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে তাহলে চাইলে বিয়ে হতে পারে [6] ।খালেস তওবা করলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন ও তার গুনাহগুলোকে নেকীতে পরিবর্তন করে দেন। সূরা ফুরকানে আল্লাহ তাআলা যেনাসহ আরও কয়েকটি কবিরা গুনাহের শাস্তি উল্লেখ করার পর বলেন: “তবে যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পুন্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু” [7]

লক্ষ্য করতে হবে, উক্ত জিনাকারী নারী গর্ভবতী কিনা! মাসিকের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। গর্ভবতী হলে সন্তান জন্মদান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর গর্ভবতী না হলে বিয়ে করা যাবে। [8,9]

প্রিয় ভাই, প্রিয় বোন ব্রেকাপ করার সময় নিজের কাছে সৎ হও। নিজের খায়েশ পূরণে ব্রেকাপ করার জন্য ইসলামকে ঢাল বানিও না। অনেক সময়ই এই দুঃখজনক ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। প্রেমিক বা প্রেমিকার মধ্যে কেউ একজন ভালো একটা প্রস্তাব পেয়েছে (দুনিয়াবি দিক বিবেচনায়। ধন সম্পদ, ক্যারিয়ার সৌন্দর্য, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি।)। বর্তমান সম্পর্ক শেষ করে এখন সেই ভালো প্রস্তাব গ্রহণ করতে আগ্রহী। এ সময় ইসলামের মুখোশ পরে দাবী করে- দেখ,আমাদের সম্পর্কটা হালাল না। আমরা প্রতিনিয়ত পাপ করছি। আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করছি। তাই চলো আমরা ব্রেকাপ করে ফেলি।

এরপর বর্তমান সম্পর্কের ইতি টেনে প্রেমের জাহাজের নোংগর ফেলে সেই ‘বেটার অপশানের’ দরজায়। পাপের কথা, আল্লাহর অসন্তুষ্টির কথা আর মনে থাকে না। আবার অনেকে বিয়ের আগ দিয়ে কিছুদিনের জন্য হুজুর সাজে যেন ধার্মিক পাত্র/পাত্রী পাওয়া যায়। একবার বিয়ে হয়ে গেলে খুলে ফেলে ইসলামের মুখোশ।

ঠিক একইভাবে অনেকেই থাকে গার্লফ্রেন্ডের সাথে জেনা করে গর্ভবতী করে ফেলে (এমন পরিস্থিতিতে পড়লে তোমার করণীয় কী হবে তা জানার জন্য কোনো আলিমের কাছে যাও)। এরপর ব্রেকাপ করার জন্য ইসলামকে ব্যবহার করে। এই মেয়ের চরিত্র খারাপ, পতিতা টাইপের মেয়ে… একে কেন আমি বিয়ে করব, ভালো পর্দানশীল মেয়ে বিয়ে করব।

এমন প্রতারণা, এমন ভন্ডামি করার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো । তুমি ব্রেকাপ করতে চাও, বেটার অপশান বেছে নিতে চাও… নিজে দায়িত্ব নিয়ে করো। কিন্তু মাঝখানে ইসলামকে টেনে এনে, হুজুর ভাব ধরে মুসলিমদের ইমেজ খারাপ করো না। এমনিতেই এই সেকুল্যার বিশ্বব্যবস্থার প্রত্যেকটি সিস্টেম দিন রাত মুসলিমদের জ ঙ্গি স ন্ত্রা সী নামানুষ ট্যাগ দিয়ে চলছে। এর মাঝে তুমি আর পরিস্থিতি খারাপ করো না। যারা ইসলাম পালন করে তারা ভন্ড, প্রতারক, জোচ্চর, লুইচ্চা – ইসলামের শত্রুদের হাতে এই অস্ত্র গুলো তুলে দিও না।

এমন ভন্ডামি, ইসলামকে ব্যবহার করে নিজের খেয়ালখুশির অজুহাত দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো।

চলবে ইনশা আল্লাহ…

বিশেষ কৃতজ্ঞতা- অনলাইন এক্টিভিস্ট শিহাব আহমেদ তুহিন।

রেফারেন্স-

[১] সূরা আন-নূর, ২৪:২

[২] আবু দাউদ

[৩] সূরা ফুরকান ২৫:৬৮-৭১

[৪] [সূরা আন-নূর: ৩]

[৫] [তাফসীরে সাদি, ১/৫৬১]

[৬] তবে এখানে একটা কিন্তু থেকে যায় । সে যে আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হয়েছে এটা বোঝার উপায় কি? এমন হবার সম্ভাবনা আছে যে সে তোমাকে হারানোর ভয়ে উপর উপর হালকার উপর ঝাপসা তাওবাহ করে বলল যে আমি সত্যই আন্তরিকভাবে তাওবাহ করেছি।[৭] [সূরা ফুরকান, আয়াত: ৭০]

[৮] [আল-ফাতাওয়া আল-জামেয়া লিল মারআ আল-মুসলিমা (২/৫৮৪)]

[৯] Is it permissible for one who has committed zina (fornication or adultery) to get married after he or she has repented?IslamQA, April 22,2001 -https://tinyurl.com/2p85r8ak

It is not permissible to marry a zaani or zaaniyah unless they have repented, IslamQA, February, 22,2007 - https://tinyurl.com/3dbbx4c6

Commited Adultery and Wants to Abort Foetus, IslamQA, February 1,2022 https://tinyurl.com/yzj943nf

He committed zina with a girl and wants to marry her, but her family are refusing and he has some questions, IslamQA, April 15,2012- https://tinyurl.com/4hdtm677

The punishment for zina (fornication, adultery) and how to keep oneself from going back to it, IslamQA,May 4,2022 - https://tinyurl.com/5pk5cwwp