Published on

সমকামিতাঃ স্বাধীনতা, রোগ নাকি ......... ?

বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম ।

সমকামিতাকে পাশ্চাত্যে ডাকা হয় ‘একটি বিকল্প লাইফস্টাইল’, ‘ব্যক্তিগত পছন্দ’ অথবা ‘প্রাকৃতিক ব্যতিক্রম’ হিসেবে, অথচ সমকামিতাকে একটি অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন এসোসিয়েশন অফ সাইক্রিয়াটিস্টের মনোবিদেরা । যদিও এখন আর অসুখের লিস্টে সমকামিতা খুঁজে পাওয়া যায়না বরং তার জায়গায় উল্টো হোমোফোবিয়া অর্থাৎ সমকামভীতিকেই এখন অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ইসলাম এবং আমরা মুসলিমরা ক্রমাগত এর বিরোধিতা করে যাবার কারণে আজ আমাদের ‘গোঁড়া’, ‘ভিন্নমতের প্রতি অসহনশীল’ ইত্যাদি বিভিন্ন কথা শোনানো হচ্ছে । আর সমকামিতার পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি খাঁড়া করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, সমকামিতা শুধুই সামাজিক অবক্ষয় বা ব্যতিক্রমী সামাজিক ব্যবহারের ফসল নয়, বরং বায়োলজিকালি এর ভিত্তি রয়েছে, অর্থাৎ কিনা কিছু মানুষ জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই সমকামী । আসুন দেখা যাক যুক্তিগুলো ।

  1. সমাকামিতার বিরোধিতা করতে গিয়ে আগেকালের সভ্য মানুষ প্রথম যুক্তি এটাই দেখাত যে, সমকামি আচরণ পুরোটাই অস্বাভাবিক । পায়ুকাম কখনই সন্তান উৎপাদনে সক্ষম নয় যা কিনা যৌনতার প্রধান উদ্দেশ্য । ‘প্রকৃতি’ আমাদেরকে সমকামি করে বানায়নি এটাই ছিল মানুষের প্রথম যুক্তি ।

কিন্তু সমকামিতার গবেষকরা, পৃথিবীবাসীর এই যুক্তির দুর্বলতাকে ততদিন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছিল যতদিন না তারা প্রাণিজগতের অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে সমকামি আচরণ প্রত্যক্ষ করে । ঘটনা হল, জাপানের উপকূলে তারা এমন কিছু সামুদ্রিক মাছের প্রজাতি খুঁজে পায় যাদের পুরুষ মাছেরা স্ত্রীমাছ হবার অভিনয় করে অন্য পুরুষ মাছের কাছে, যাতে করে অন্য পুরুষেরা তাদের স্ত্রীদের গর্ভধারণের কারণ না হয় । তারা আরও দেখে যে আফ্রিকার এক ধরণের প্রজাপতির পুরুষেরাও এই কাজটি করে থাকে ।

আমাদের পাল্টা যুক্তি হল, যদি অন্য প্রাণীর আচরণ দিয়ে মানুষের আচরণ জাস্টিফাই করা লাগে তাহলে দক্ষিণ আমেরিকায় একধরণের মাকড়সা পাওয়া যায়, যার নারী সদস্যরা পুরুষের চাইতে আকারে বড় হয় এবং যৌনসঙ্গমের পর নারী পুরুষকে খেয়ে ফেলে । (তাহলে কি কিছুদিন পর এই আচরণও আইনের আওতায় আনা যাবেনা আর আমাদের স্ত্রীরা এরকম ক্যানিবালিজম চালু করলেও এটা স্বাভাবিক হবে? )

  1. মানুষের মস্তিস্কের একটি গ্ল্যান্ড আছে যা পুরুষের একটু বড় এবং মেয়েদের ছোট হয় । ’৮০ এর দশকে দাবি করা হয়, সমকামি পুরুষদের এই গ্ল্যান্ডটি ছোট বলেই তারা সমকামি ।

কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে এই দাবি বেশিদূর এগোতে পারেনি । গ্ল্যান্ড ছোট প্রমাণ করার জন্য সমকামি গবেষকরা বেছে নিয়েছিল মৃত সমকামি পুরুষদের মস্তিস্ককে । বিজ্ঞানীরা এই ডেটাকে পাত্তা না দেবার এক নম্বর কারণ হল মস্তিস্কগুলো মৃত । এমন হতে পারে মৃত্যুর পর সেটি ছোট হয়েছে । আর দ্বিতীয়ত গ্ল্যান্ড ছোট হয়ে যাওয়ার কারণে তারা সমকামি নাকি সমকাম চরিতার্থ করবার কারণেই তাদের গ্ল্যান্ড ছোট হয়ে গেছে তা জানা যায়না । এমনও হতে পারে যে তারা জন্ম নিয়েছিল সঠিক সাইজের গ্ল্যান্ড নিয়ে কিন্তু সমকামিতার কারণে তা বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে গেছে । (এরকম ঘটনা ঘটার প্রমাণ আছে অন্য গ্ল্যান্ডের ক্ষেত্রে)

  1. সাম্প্রতিককালে জেনেটিক্স দিয়ে সমকামিতাকে সবচাইতে বেশি ‘স্বাভাবিক বানাবার প্রয়াস চলছে । ১৯৯৩ সালে National Cancer Institute এর ড. ডীন হেমার, গে জিন আবিস্কারের দাবি করেন, “the first concrete evidence that ‘gay genes’ really do exist.”

এই আবিস্কার হেমারের জীবনকে বদলে দেয় । সাদামাটা একজন গবেষক থেকে হেমার হয়ে যায় বিখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব । প্রেস্টিজিয়াস জার্নালে হেমারের গবেষণা প্রকাশিত হলে সংবাদপত্রের হেডলাইন থেকে টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ হয় হেমার । তার দাবি ছিল, সমকামি পুরুষেরা তাদের মায়েদের এক্স ক্রোমোসোমের থেকে এই বৈশিষ্ট্য পায় । কলরোডো সুপ্রিম কোর্টে হেমারের টেস্টিমোনি, সমকামি বিরোধী আইনকেও রদ করে দেয় ।

কিন্তু মজার ব্যাপার হল হেমারের অনুসরণ করা পদ্ধতি অনুসরণ করে, ওয়েস্টার্ন ওন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সেই গে জিন আবিস্কার করতে ব্যর্থ হন । পরবর্তীতে দেখা যায় হেমারের গবেষণায় কোন control group ছিলনা, যা কিনা বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি মৌলিক বিষয় । কিন্তু আসল মজার তখনও বাকি ছিল ।

জুন ১৯৯৪ তে শিকাগো ট্রিবিউন রিপোর্ট করে, হেমারের ল্যাবোরেটরির একজন জুনিয়র এসিস্টেন্ট, যে কিনা গে জিন আবিস্কারের সময় সহায়তা করেছিল, ইচ্ছে করে করে সিলেক্টিভ রিপোর্ট করেছে । ঐ মহিলাকে হেমারের ল্যাবে post-doctoral fellowship থেকে অব্যহতি দেওয়া হয় । এবং হেমার যদিও তার আত্মজীবনীতে নিজের যৌন পরিচয় গোপন রেখেছিল, পরে সে তার লেকচারে স্বীকার করে যে সে সমকামি ।

(সমস্যা হল হেমারের আবিস্কার পত্রপত্রিকার হেডলাইন হলেও, পরের কেচ্ছাগুলো তেমন মিডিয়া কভারেজ পায়নি । তাই জনসাধারণের মনে এখনও গে জিনের ভূত খুঁটি গেড়ে বসে আছে )

  1. ইসলাম হঠাৎ করে পৃথিবীতে সমকামবিরোধি আইন আনেনি । বরং মানুষের ইতিহাস সমকামকে ঘেন্না করেছে । Torah তে স্পষ্টভাবেই এই আচরণকে কন্ডেম করা হয়েছে ।
  2. ফলাফল হিসেবে এইডস রোগই যথেষ্ট এটা প্রমাণ করার জন্য যে সমকামিতা সমাজের জন্যে ভয়াবহ । এইডস প্রথমদিকে সবচাইতে বেশি ছড়িয়েছে সমকামি কমিউনিটিগুলোর মধ্যে । এবং তারপর এটি ড্রাগ ও রক্তদানের মাধ্যমে এবং সবশেষে সাধারণ যৌন আচরণের মানুষের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়ে ।

(পায়ুকাম ও এর কারণে রক্তপাত এইডস সংক্রমণের জন্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ । একজন এইডস রোগীর সঙ্গে স্বাভাবিক যৌন আচরণের ফলে এইডসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা, পায়ুকামের তুলনায় নগণ্য । তাই সবচাইতে মজার ব্যাপার হল, ঘোর সেক্যুলাররাও এইডস সংক্রান্ত সেমিনারে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার উপদেশ দেয় )

  1. ইসলাম সমকামিতাকে সম্পূর্ণ ব্যক্তি মানুষের পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করে।এটি কোন রোগও নয়।এটা কখনই হতে পারেনা যে ঈশ্বর কিছু মানুষকে সমকামি করে সৃষ্টি করলেন এবং তারপর একে একটি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তির বিধান দিলেন। আল্লহ কখনই এরকম অবিচার করেননা।কোন বিষয়ের প্রতি বহু মানুষের ঝুঁকে পড়াটাই সে বিষয়টি স্বাভাবিক হবার জন্য যথেষ্ট নয়।মানুষের সমাজে নানা অনাচার প্রবণতা দেখে দিতে পারে আধুনিক মানুষের জটিল জীবনযাত্রার বিভিন্ন ধরণের স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক কার্যকলাপের কারণে; সেটা হতে পারে ব্যভিচার থেকে ধর্ষণ, নেক্রফিলিয়া থেকে পাশবিকতা।এসব অনাচারের পিছনে জিনগত বৈশিষ্ট্য দায়ী হতে পারে, দায়ী হতে পারে মিডিয়ার প্রভাব কিংবা মানুষের কুমন্ত্রণা।

মানুষ রোবোট নয় । তার নিজস্ব বুদ্ধি বিবেচনা দিয়েই সে কাজ করে এবং আল্লহ তার সেই কাজের হিসাব নেন যা সে জেনে বুঝেই করে । যদি সমকামিতা আসলেই জিনগত কারণে হত, ঈশ্বর কখনই একে পাপ হিসেবে চিহ্নিত করতেন না ।

একেবারে সম্প্রতি কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, পেশাদার খুনিদের কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য মানুষ থেকে আলাদা । তাই বলে কি কাল থেকে আমরা খুনিদের ক্ষমা করে দিয়ে, মানুষ হত্যা আইনত জায়েজ করে দেবো ?

  1. ইসলাম মা-বাবা হিসেবে আমাদের নির্দেশ দেয়, আমরা যেন ১০ বছর বয়স থেকে আমাদের সন্তানদের বিছানা পৃথক করে দেই যাতে করে শৈশবের শিশুসুলভ কৌতুহল থেকে উৎসারিত কোন অনাকাঙ্ক্ষিত যৌনতা, আমাদের সন্তানদের স্পর্শ না করে । এমনকি স্কুলে বা অন্য এডাল্টদের দ্বারা আক্রান্ত হবার কারণেও এ ধরণের ঘটনা যে ঘটতে পারে, সে সম্পর্কেও আমাদের সচেতন থাকতে হবে ।

ইসলাম আমাদের আরও শিক্ষা দেয় যেন সমাজে পুরুষ ও মহিলাদের একদম ক্লিয়ার কাট পার্থক্য বিদ্যমান থাকে পোশাকে, ব্যবহারে । রসূলুল্লহ সল্লাল্লহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম লানত করেছেন সেসব পুরষদের যারা মহিলাদের নকল করে আরও লানত করেছেন মহিলাদের যারা পুরুষের মত আচরণ করার চেষ্টা করে । দুঃখজনক হলেও সত্যি, আজকের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিগুলো অধিকাংশই সমকামিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । সমকামিরা ইচ্ছে করেই এমন পোশাক বানায় যা পুরুষ না মহিলার বোঝা দায় । এর কারণেই ছেলেদের পোশাকে ধীরে ধীরে নারীত্বের ছাপ আসছে । অন্যদিকে মেয়েরা পরছে স্যুট, টাই আর ছেলেদের জুতো ।

[ লেখাটি Dr. Abu Ameenah Bilal Philips এর Contemporary Issues বই থেকে ভাবানুবাদ করা । ব্রাকেটের লেখাগুলো অনুবাদকের, লেখকের নয় । অনুবাদ করেছেন Salman Saeed । আল্লাহ্‌ তাঁকে উত্তম প্রতিদান দান করুক । ]