- Published on
স্বর্গের দিন স্বর্গের রাত (চতুর্থ পর্ব)
[১]
জীবনের সব প্রথমই মানুষ মনে রাখে। স্বাদ বিস্বাদ যা-ই হোক । প্রথম বিস্বাদ যত তীব্র হয়, স্বাদ তত মজার হয় না। এজন্য বার বার ফিরে পেতে চায়। পায়ও। সারাজীবনেও আর সেই প্রথমকে ভুলতে পারেনা। পঞ্চমবার আমেরিকায় এসে প্রথমবারের কথা মনে হচ্ছে। সেইবার ডালাসে যে ধর্মীয় পরিবেশ ছিল, এটা এবার তেমন নেই।
ডালাসের রিচারডসনে উঠেছি আমি। অনেক বাঙালী পরিবার বসত গেড়েছে এখানে। অনেকে দেশে সব বিক্রি করে দিয়ে আমেরিকান হয়েছে। ভাগ্য ভালো যার, বাড়ি-গাড়ি করেছে। আর নতুবা ভাড়া বাড়িতেই কাটছে জীবন। বাস –ট্রেনে যাতায়াত। বুয়েটের অনেক ইঞ্জিনিয়ার আছে, তাদের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। চাকুরী না থাকলে তাদের অবস্থাও কাহিল হয়ে যায়।
বউ ছাড়া থাকতে পারলেও এদেশে চাকুরী ছাড়া থাকা যায়না। আবার চাকুরী খুব ভালো হলে বউ হারানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। স্বামীর সম্পদ বেড়ে গেলে অনেক স্ত্রী ডিভোর্সে উৎসাহী হয়ে ওঠে। তখন তারা স্বামীর সম্পত্তির অর্ধেক পায়। সেলিব্রেটিদের মধ্যে এটা বেশি হলেও এখন আমজনতাও এর স্বাদ পাচ্ছে। মুসলমানরাও বাদ পড়ছে না। আমাদের কাছে সবই সমস্যা লাগে। তাদের কাছে সব এক। বেঁচে থাকলেও যা, মরে গেলেও একইরকম। কালচারে মুসলমানরা এক হতে হতে এখন সমবিশ্বাসেও এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথম জেনারেশন সারেন্ডার না করলেও থার্ড জেনারেশন নাগালে পাওয়া মুশকিল। ব্যতিক্রম আছে। সেটা প্রফেসর হযরত হামীদুর রহমান সাহেবকে দেখে সন্তানকে স্কুল-কলেজে পড়ানোর মতোই। একদিন আমার ছেলেও হামীদুর রহমান সাহেব হবে!
বিভিন্ন দেশের মানুষ আসে আমেরিকায়। মুসলমাররাও আসে। অনেকে পরিবার নিয়ে আসে। অন্যরা যা ইচ্ছা করে। মুসলমানরা তা করতে পারেনা। কিন্তু শুরুটা প্রায় সবার একইরকম। প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ধাক্কা সামলাতে হয়। আর এজন্য প্রয়োজনে সব কিছুই জায়েজ মনে হয়। এ তালিকা অনেক বড়। তবে মুসলমানদের ভয়ানক কিছু করতে হয়। তাদের দ্বীনদারীতে কম্প্রোমাইজের চাপ বাড়ে। অনেকে দেশে থাকতে হয়তো নামায পড়তেন না। এখানে এসে আরও উদাসীন হন। আর যারা নামায পড়তেন, তাদের অনেকেই ছাড় দেন। এই ক’দিন পরেই সাচ্চা নামাযী হয়ে যাব। তাদের জন্য দিন আর শেষ হয়না। একসময় হয়তো নামায পড়েন, তখন বেলা পড়ে যায়। অবেলার দ্বীনদারীতে পরবর্তী জেনারেশন টেকানো যায় না। সব স্যাটেল হয়ে গেলেও ইসলামের মূল্যবোধ ঠিক থাকে না। মুখ থুবড়ে পরে।
[২]
এদেশ অনেক বড় দেশ। শুধু নিউইয়র্ক শহর দেখলে দেশ বোঝা যায় না। শহর থেকে বের হয়ে কোনো হাইওয়েতে উঠলেই চোখে পড়ে। কত যে প্রান্তর খালি পড়ে আছে।, হিসেব নেই। অন্যান্য স্টেটে আরো বেশি। প্রকৃতির বিশালতায় মানুষের মনও বিশাল হওয়ার কথা। মন তো এক অনন্য সৃষ্টি। এটা বিশাল হবার জন্য জায়গা লাগে না। দ্বীনের সঠিক বুঝ লাগে। এখানে কেন যেন সেটা উবে যায়!
মুসলমাররা অনেকেই হালাল-হারাম বেছে চলে। অনেকে পারেনা। আমার এলাকার পরিচিত একজন মদ খান না। কিন্তু মদের ভালো ককটেল বানাতে পারেন। তিনি যে হোটেলে কাজ করেন,এজন্য তার অনেক সুনাম। দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। ছেলেদের এদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা পড়ালেখা করে বড় চাকুরী করছে। বাবা খুব খুশি। তারপর ? হঠাত এক ছেলে খৃস্টান মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল। আরও দুই ছেলের অবস্থা বলার মতোনা। হারাম কামাই করে হয়তো প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়, মুসলমান থাকা যায়না। অনেক মুসলমান ঘরেই এই এক নতুন সমস্যা। ছেলে তো ইসলামেই থাকছেনা।
খুব বেশি তাবলীগে সময় দেন যারা, অথবা সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়ান, তাঁরা ছাড়া বাকীদের অবস্থা একইরকম। কী রকম? তারা ছেলেদের একটু কুরআন পড়িয়ে দিতে পারলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। আর মাঝে মাঝে যদি মসজিদে নিতে পারেন,তাহলে তো ছেলের মুসলমানিত্ব নিশ্চিত । এভাবে হয় না কিছুই। বেশিরভাগই বাবা-মাকে খুশি করার জন্য এসব করে। বয়স আঠারো হয়ে গেলেই ছেলে আসল আমেরিকান হয়ে ওঠে। তখন বাবা-মাদের আর কিছু করার থাকেনা। ছেলের বিয়ের বয়স হয়ে গেলেও জোর করতে পারে না। ছেলের ইচ্ছের কাছে নত হয়ে থাকতে হয়। আর এতে যদি হারাম কামাইয়ের হিস্যা থাকে, ঐ ছেলের ভাবভঙ্গি বোঝা মুশকিল হয়ে ওঠে। সমাজ তো এখানে সামাজিক না। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ । কেউ কিছু মনে করেনা।
যারা দ্বীনদারী রক্ষা করে চলার খুব চেষ্টা করেন, তারা নিজেরা নামায-কালাম পড়েন। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কিছু কসরত করেন। কিন্তু তা’লীম দেন না। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আর কুরআন তিলাওয়াত ছাড়া ইসলামের আর কিছু শেখে না। রাসূলের নাম বলতে পারলেও সাহাবী কি জিনিস জানে না। ইসলামের নিজস্ব কালচার আছে, এ বোধ উন্মেষের কোনো সুযোগই পায় না। তারা আমেরিকান কালচার নিয়ে পড়ে থাকে। ঘরে-বাইরে। খুব সহজেই দ্বীনদারী বিদায় নেয় । এটা হলো সেকেন্ড জেনারেশন। এরা নিজেরা যা শিখেছে, তা প্রাক্টিস করে না। থার্ড জেনারেশন আসতে আসতে সব ভুলে বসে। একদিন মুসলমান ছিল, এ বোধও আর কাজ করে না। আর খ্রিস্টান বিয়ে করলে তো আমেরিকা জিন্দাবাদ ।
.[৩]
বাইরে আজ আইস কুল ঠাণ্ডা । হাত-পা জমে যাওয়ার মতো অবস্থা । তবু মানুষগুলো জমে যায় না । মুখে ঘন হাওয়া ছাড়তে ছাড়তে দিব্বি বেঁচে থাকে । কাজে যায় । ফিরে আসে । ঘরেই কাটে বেশিরভাগ সময় । ঘরে হট এয়ার সিস্টেম আছে। অনবরত হিটার চলছে । হিটারে শরীর গরম হয় । আত্মার শান্তি মেলে না । শান্তি দেওয়ার মানুষ টাই নেই । শুন্য ঘর । সেলফোন আর টিভি ছাড়া সঙ্গি কেউ নেই । অনেকের কুকুর থকে । একটা, দুইটা বিড়ালও থাকে । সবার থাকে না বড় নিঃসঙ্গ জীবন । এদেশে এরকম জীবন যে কত, পরিসংখ্যান জানা নেই । মুসলমানও দিন দিন এ সংখ্যা বাড়াচ্ছে ।
ফজরের পর স্টারবাকসের কফি খাচ্ছি। ভোর পাঁচটায় এ দোকান খোলে। সূর্য ওঠে আরও পরে। সকাল সাড়ে সাতটায়। মানুষ এখানে রোবটের মতো কাজে লেগে যায়। এই একটা জায়গায় কোনো তাড়া দিতে হয় না। ডলার তাকে মেশিন বানিয়ে ফেলে। উপায়ও নেই। কফি খেতে খেতে আমার ভাই গল্প করছেন। এদেশের মানুষের গল্প। কঠিন সব গল্প। শুনলে গা শিউরে ওঠে।
এক ভদ্রলোক দেশ থেকে কেবল বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছন। নিজে অড জব করে বউকে ডাক্তার বানালেন। পাস করেই বউ তাকে ফেলে চলে গেল। কোথায় বউয়ের কামাইয়ে আলিশান জীবন কাটাবে, এখন বউই নাই। অবশ্য বউয়ের কামাইয়ের দিকে এদেশে চেয়ে থাকার সুযোগ নেই। শেয়ারে হয়তো একটু ভালো বাসায় থাকা যেতো, এই যা।
এখানে বউ-ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে মানুষের আশাও কমে যায়। ভালো বাসায় থাকতে পারলেও ভালোবাসা হয় না। মহব্বতকে ওরা বলে ফিলিংস। এই ফিলিংস বুঝতে আমার সময় লেগেছে। হাই ড্যাড (Hi Dad)! বলা তাদের ফিলিংসের প্রকাশ। তাও বছরে একবার!
.আরেকদিন এক বাঙালী ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলো। সঙ্গে আমার ভাই। ভদ্রলোক এসে আমাদের খুব আন্তরিকভাবে এক অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিলেন। তার স্ত্রী নার্সিং কোর্সে কোয়ালিফাই করেছে। এজন্য গ্র্যাজুয়েশন পার্টি হবে। সেখানে যেতে বললেন। লোকটার খুশি দেখে আমি অবাক। শেষ পর্যন্ত স্ত্রী থাকবে তো!
.সেকেন্ড জেনারেশনেরও বউ থাকছে না। বাবা-মা সত্তর থেকে আশি হাজার ডলার খরচ করে ওয়েডিং পার্টি করছে। এক বছরের মাথায় বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে। হু কেয়ারস! দু-জনই উচ্চ শিক্ষিত। ভালো চাকুরী করে। সামান্য ইস্যুতেই ঘর ভেঙ্গে যাচ্ছে। তখন এসব ভাঙ্গা মন কী করে? সে বিষয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ভুক্তভোগীরা জানে। অন্যের জানার সুযোগ হয় না।
এদেশে একার কামাইতে সংসার চলেনা। স্ত্রীকেও কাজ করতে হয়। সেটা আরেক জীবন। অফিস ডিউটি খুব কম পরিবারই করে। বেশিরভাগ অড জব। তাতে টাইমিং ঠিক থাকেনা। একজন যদি বিকেলে ঘরে ঢোকে, আরেকজন রাত বারোটায়। ভালোবাসা তখন টায়ার্ড হয়ে যায়, ডলার গুনেই পার করতে হয় পারিবারিক জীবন।
অনেকের স্ত্রী আমৃত্যু থাকে। বুড়ো হয়ে গেলেও পাশে থাকে। একজন অচল হলে আরেকজন হুইল চেয়ার ঠেলে। ভালোবাসা তখন আসল হয়। মরে গেলেও এদেশে শান্তি নেই। কাফন-দাফনে প্রায় দশ হাজার ডলার লাগে। আসল ভালোবাসা তখনো ডলারের চিন্তা থেকে মুক্তি পায়না। আমেরিকার ঘোর কাটলেও আর ফেরার সুযোগ থাকেনা।
[৪]
খুব ভালো থাকতে মন চায়। খুব ভালো হতে ইচ্ছে করেনা। ইচ্ছেটাই পাল্টে গেছে। মরা গাছে ফুল ফোঁটে না। এমনিতে ফুল ভালো লাগে। গাছের পরিচর্যা করতে ইচ্ছে করে না। এখানে গাছ কি ছিল নাকি! একদিন হয়তো ছিল। সে গাছ মরে গেছে। এখন ঝরা পাতায় উঠোন ভর্তি। সেখান থেকে ফুলের টবে প্লাস্টিকের ফুল ফোঁটে। শিশিরে সিক্ত হয়। আহ! কি সৌন্দর্য! এ সৌন্দর্যে মুসলমানরা দিশেহারা। একবার দিশা হারালে হুঁশ ফেরানোর কেউ নেই। বিচ্ছিন্ন দ্বীপে কেউ সহজে প্রবেশ করে না।
বসবাসের জন্য একটা বাড়ি এদেশে খুব জরুরী। আর চলাফেরার জন্য একটা গাড়ি। হোটেল বয় হিসেবে কাজ করলেও এগুলো পেতে অসুবিধা হয় না। বাড়ি-গাড়ি রেডিই আছে। একটু কষ্ট করে কেবল সাহস করতে হয়। মনে সাহস না থাকলেও পরিবেশ সাহসী করে তোলে। গাড়ির দোকানে পয়সা ছাড়া গেলেও একটা কিনে ফেরা যায়। বাড়ির জন্য একটু ঝামেলা সইতে হয়। ইনকামের ওপর উপর বাড়ির কোয়ালিটি ডিপেন্ড করে। সবই মেলে মরগেজ (Mortgage)- এর উপর। বিশ্বাসে কমতি নেই এদের। সোস্যাল কার্ড থাকলেই আর কিছু চাইবে না। হাউজ লোন দিয়ে দেবে। মরে গেলেও অনেকের এ লোন শোধ হবে না। ব্যাংক তার হিস্যা বুঝে নেবে ঠিকই।
আমেরিকার ইকোনোমি সিস্টেম খুব কঠিন। সমাজের কণায় কণায় সুদের চাকা ঘুরছে। দ্বীনদাররা বেঁচে থাকতে চায় না যে এমন না। পারে না। ঘন্টায় দশ ডলারে কাজ করে সুদের চাকায় তেল না দিয়ে উপায় থাকেনা। খুব ভালো বেতনে যারা প্রফেশনাল জব করেন, তারা চাইলে কিছু পারেন। নগদ টাকায় বাড়ি-গাড়ি করেন। এ দলে লাখে এক মিললেও বেশি। শীতের কষ্টে হাত পকেটে রাখতে হয়। আর সুদের ঘোরে চোখ-কান খোলা রাখা যায় না। জিবটাকে সচল রাখলেই চলে।
বাড়ি-গাড়ি করে অনেকে বিয়ে করে। এদেশে মানুষ অন্যের খবর রাখে না। তবে বিয়ে-শাদীর খবর ঠিকই রাখে। দাওয়াত দিলে ছুটে আসে। নিজেকে চেনানোর এই সুযোগ হাতছাড়া করে না কেউ। বিশাল করে ওয়েডিং পার্টির আয়োজন করে। হাজার হাজার ডলার লোন করে। ক্রেডিট কার্ডে সুদের ধাক্কা লাগে। অন্তরে লাগেনা। মেহমানদের হাসি-তামাশায় অন্তর ফুলে ওঠে। আগুনের পর আগুন জ্বলে। আগুন ছাড়েনা কাউকেই। দেখা যায়, লোন শোধ না হতেই বিয়ে ভেঙ্গে যায়। বউ নাই। বিয়ের লোন টানতে হচ্ছে। তারা অবশ্য আবার বিয়ে করে। তবে প্রথমবারের মতো তামাশা আর করতে পারে না।
সুদের আগুন দেখা যায় না। পুড়ে ছারখার করলেও দেখা যায় না। এজন্য শিক্ষাও নেয় না কেউ। সম্ভবত কবরে না গেলে হুঁশ ফিরবে না কারোরই।
চলবে ইনশা আল্লাহ...
রেফারেন্সঃ
একা একা আমেরিকা, পৃষ্ঠা ৭৫-৮২, লেখকঃ মুহাম্মাদ আদম আলী, প্রকাশনীঃ মাকতাবাতুল ফুরকান
পড়ুন আগের পর্বগুলোঃ
স্বর্গের দিন স্বর্গের রাত (প্রথম পর্ব)
স্বর্গের দিন স্বর্গের রাত (দ্বিতীয় পর্ব)
স্বর্গের দিন স্বর্গের রাত (তৃতীয় পর্ব)
আরো পড়ুনঃ