Published on

রূপকথা নয়! (শেষ পর্ব)

বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম।

মেয়েটি মেঝেতে শুয়ে ছিল সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায়। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে যাচ্ছিল।

যুবকটি ছিল ঘরের এককোণায়, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিল সে... কাঁদছিল অঝোরে। যুবকের একহাত পাশে রাখা একটা বাতির আগুনের মধ্যে ধরা। বাতাসে মাংস পোড়ার তীব্র কটু গন্ধ।

যুবকই কাঁদছে আর কাঁদছে.... ওইদিকে মেয়েটি চিৎকার করছে....লোকেরা মেয়েটিকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল আর মেয়েটি ভয়ার্ত কন্ঠে বলতে থাকলো,‘ তোমরা আমাকে এই যুবকটার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাও । আল্লাহর শপথ! এর ঈমান আমাকে শেষ করে দিচ্ছে... আমি আমার সামনে এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি যা আমি তোমাদের বোঝাতে পারবো না... আর এটা আমার অন্তর পুড়িয়ে দিচ্ছে, আমার ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে... এই যুবকের ঈমান আমাকে খুন করে ফেলছে, আমাকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি নিয়ে চলো’।

ইমেইজ কার্টেসিঃ shutterstock

মেয়েটি তার রূপের ফাঁদে ঠিকই গেঁথে ফেলেছিল যুবকটিকে। মেয়েটির আহ্বানে সাড়া দিতে যুবকটি এক পা দুই পা করে আগাচ্ছিল তার দিকে। কিন্তু এই নাজুক মুহূর্তেও যুবকটি তাঁর রবের কথা,রবের শাস্তির কথা ভুলে যায়নি, মেয়েটির দিকে একটি করে ধাপ আগানোর পর সে তার হাত বাতির আগুনের ওপর ধরছিল এবং নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল,‘মনে রাখিস, জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার এই আগুনের চেয়েও বেশী উত্তপ্ত’। তীব্র বেদনায় সে মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিল । আবার সে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। মেয়েটির দিকে আরেক কদম এগিয়ে যাচ্ছিল... আর যখনই সে মেয়েটির দিকে আবার আগানো শুরু করছিল, তখনই সে তাঁর হাতটাকে আগুনে ঠেলে দিচ্ছিল এবং নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল,‘মনে রাখিস, জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের চেয়েও বেশি তীব্র’।

মেয়েটিকে সেই ঘর হতে সরিয়ে নেবার পর সেই যুবক অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে প্রত্যাবর্তন করলো আল্লাহ’র (সুবঃ) নিকট- ‘ইয়া আল্লাহ! আমি যে গুনাহ করেছি তার জন্য আমাকে ক্ষমা করুন”।

কী ছিল সেই গুনাহ? কী করেছিল সে?

সে যিনা থেকে বিরত ছিল।

সে ওই জমিনের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের কাছে যাওয়া থেকে বিরত ছিল ।

সে কি আসলে কোন গুনাহ করেছিল!

অথচ সে বলল, হে আল্লাহ! মেয়েটির দিকে বাড়ানো আমার সেই পদক্ষেপগুলোর জন্য আমাকে ক্ষমা করুন। [১]

দুই.

সৌদি আরবের জেদ্দার এক তরুণের গল্প এটি । খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। সেই তরুণ ছিল আল্লাহ্‌র এক অনুগত বান্দা,কুরআনের একজন হাফিজ এবং এক মসজিদের মুয়াজ্জিন। একবার সে আর তার বন্ধুরা মিলে তার দাদার গ্রামে বেড়াতে গেল। সেখানকার অভাবী,দুঃস্থ মানুষদের মধ্যে তারা খেজুর,ইসলামিক বইপত্র, প্যামপ্লেট,সিডি ইত্যাদি বিতরণ করল। তার দাদার গ্রামটি ছিল জেদ্দার খুব কাছেই, সব বন্ধুরা সেদিনই শহরে ফিরে গেল। থেকে গেল শুধু সেই তরুণ।

.

রাতে খাবার দাবার, গল্পগুজব করার পর সে ড্রয়িংরুমেই ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন শুরু করল। তার দাদা তাকে ঠেলে ভেতরের একটা ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। ছেলেটা বিছানা ঝেড়ে,ঘুমানোর দু’আ গুলো পড়ে শুয়ে পড়লো। সারাদিনের দৌড়াদৌড়ির কারণে সে ছিল খুব ক্লান্ত। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে খুব একটা সময় লাগলোনা।

.

অনিন্দ্যসুন্দরী এক যুবতী সেই বাড়িতে কাজ করতো। সারাদিন তক্কে তক্কে ছিল সে।রাত গভীর হতেই সে সটান হাজির হলো সেই তরুণের ঘরে।

তারপর?

তারপরের ঘটনা চল শুনি সেই তরুণের মুখ থেকেই।

‘...মনে হলে আমার ঘরের দরজাটা বেশ ক’বার খুললো এবং বন্ধ হল। আমি তেমন একটা পাত্তা দিলাম না। দুচোখে রাজ্যের ঘুম ছিল। মনে হচ্ছিল বাস্তবে নয় স্বপ্নে দরজা খুলতে এবং বন্ধ হতে দেখছি।

তারপর হটাত আমি টের পেলাম কে জানি আমার পাশে এসে শুল। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই মানুষটা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল।

তারপর? তারপর কি ঘটেছিল? কি ঘটেছিল সেই রাতে?

তরুণটি এক ঝটকায় সুন্দরী যুবতীকে দূরে ঠেলে দিল। গালে কষে কয়েকটা চড় মারলো। তারপর তড়িঘড়ি করে কাপড় পরে দৌড় দিল মসজিদের দিকে।আল্লাহ্‌র ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গিয়েছিল। সে থর থর করে কাঁপছিল। ফজরের আযানের আগ পর্যন্ত সে মসজিদে বসে শিশুর মতো কাঁদছিল।

সকালবেলা তার চাচাকে সব খুলে বললো। যুবতী কাজের মেয়েটিকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। এই ঘটনার শক সহ্য করা ঐ তরুণের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে সে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লো। [২]

.

এই দুইটা ঘটনা জানার পরে আমি কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিলাম। ভাই তুমি,একবার নিজেকে কল্পনা কর ঐ ছেলেটির জায়গায়। তোমার তরুণ শরীর,তোমার টগবগে রক্ত,রাতের নিকষ কালো চাদরের আড়ালে এক সুন্দরী স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছে তোমার কাছে। কোথাও কেউ নেই। কাক পক্ষীও টের পাবে না কিছুই, এমন সময় তুমি কি করবে? কি করাটা স্বাভাবিক? আনন্দে হার্ট এটাক করলেও অবাক হবার কিছুই নেই।

.

বাসা খালি পেলে বা একা রুম পেলে আমাদের মাথায় কি চিন্তা ঘোরাফেরা করে?

পর্ন দেখার বা মাস্টারবেট করার এইতো সুযোগ, তাইনা?

লেটস বি অনেস্ট।

বাসায় কেউ ছিল না বা রুম ফাঁকা ছিল আর আমরা পর্ন দেখিনি,মাস্টারবেট করিনি বা কোন মেয়েকে নিয়ে সেক্স ফ্যান্টাসিতে ডুবে যাইনি এমন কবার হয়েছে?

বুকে হাত রেখে আমাদের সত্যি কথা বলার সাহসটা হবে কখনো?

সুবহান আল্লাহ! এই দুই ছেলের ঈমানের শিকড় কি গভীর মাটিতে প্রেত্থিত। গভীর রাতে অপরূপা যুবতীরা নিষিদ্ধপ্রেমের যে ঝড় তুলেছিল তাতেও বিন্দুমাত্র টলেনি তাদের ঈমান, যে সুযোগ পেলে বহু পুরুষ বর্তে যেত, যে সুযোগের কথা ভেবে কত তরুণ অস্থিরতায় ভোগে সেই সুযোগ পাওয়ায় পরেও তা ছুড়ে ফেলে দিতে এতোটুকু দ্বিধায় ভোগেনি এরা।

হায় আমাদের ঈমান কতো ঠুনকো!

.

একাকী রুমে এক অবাস্তব জগতের ধরা যায়না ছোঁয়া যায়না এমন পর্নস্টাররা আমাদের চিন্তায় আসামাত্র আমাদের ঈমান হাওয়া হয়ে যায়। নেটে লগইন করে পর্ন দেখতে,মাস্টারবেট করতে আমাদের বিন্দুমাত্র দেরি হয়না। পার্কের চিপায়,রিকশার হুডের নিচে,বাসের পেছনের সিটে, লিফটে আমরা নির্জনতা খুঁজি, লোকাল বাসের ভীড়ে,কনসার্টে আমরা সুযোগ খুঁজি। সারাদিন জাস্ট ফ্রেন্ড জাস্ট ফ্রেন্ড ,ভাইবোন খেলা খেলে গভীর রাতে বাথরুমে নিজেদের ঠান্ডা করি।

.

পাপ করতে করতে আমাদের এমন অবস্থা হয়েছে পাপকে আমরা আর পাপ মনে করি না। মাস্টারবেট করার পর বা পর্ন দেখার পর আমাদের খারাপ লাগে না । এইটা এমন কোণ ব্যাপারই না আমাদের কাছে। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

.

এই দুই ছেলেও তো আমাদের মতোই রক্তমাংসের মানুষ ছিল,তাদেরও তো আমাদের মতোই একটা হৃদয় ছিল, সেই হৃদয়ে কামনা বাসনা ছিল,ছিল নারীর প্রতি দুর্বোধ্য আকর্ষণ। কিন্তু সেই কামনা বাসনার কাছে তারা মাথা নত করেনি।

.

এরাও আল্লাহর বান্দা,আমরাও আল্লাহ্‌র বান্দা,কিন্তু ওদের সঙ্গে আমাদের আকাশ পাতাল পার্থক্য। হাশরের ময়দানে আল্লাহর আরশের ছায়ায় বসে এরা যখন কাউসারের পানীয় পান করবে তখন হয়তো রাতের আঁধারে করা আমাদের পাপের কারণে অপমানিত করা হবে। [৩]

.

এক শায়খের মুখে এক ছেলের কথা শুনেছিলাম যে প্রত্যেকদিন ১২,০০০ এরও বেশিবার আল্লাহ’কে (সুবঃ) স্মরণ করতো। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল,‘ কেন তুমি এতো বার আল্লাহকে স্মরণ কর?’

সে উত্তর দিল, ‘ যেন আমি আবু হুরাইরাহকে (রাঃ) হারাতে পারি। আবু হুরাইরাহ (রাঃ) এর চেয়ে বেশি আল্লাহ্‌কে স্মরণ করতে পারি। [৪]

.

চলোনা ভাই, আমরাও প্রতিযোগিতায় নামি ঐ দুই ছেলের সঙ্গে। তাঁরা যদি ডানাকাটা পরীদের উপেক্ষা করতে পারে তাহলে কেন আমরা সামান্য পর্নমুভি দেখা ছাড়তে পারবোনা, মাস্টারবেশন বন্ধ করতে পারবোনা?

(শেষ)

==========

পড়ুন প্রথম পর্বঃ https://goo.gl/MnLKoB

==========

রেফারেন্সঃ

[১] https://goo.gl/8oXX1S

[২] https://goo.gl/J3ukah

[৩] https://goo.gl/DhJTCX

[৪] http://bit.ly/2g7DbrR