Published on

অবক্ষয়কাল

অতীত

. ইতিহাসের দিকে তাকালে সভ্যতা ও যৌনতার সম্পর্কের একটা প্যাটার্ন দেখা যায়। বারবার বিভিন্ন সভ্যতায় এই প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। প্যাটার্নটা কী? . সোশ্যাল অ্যানথ্রোপলোজিস্ট জন ড্যানিয়েল আনউইন ৫,০০০ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে ৮৬টি আদিম গোত্র এবং ৬টি সভ্যতার ওপর এক পর্যালোচনা করেন। আনউইন এ গবেষণা শুরু করেন সভ্যতাকে অবদমিত কামনা-বাসনার ফসল হিসেবে দাবি করা ফ্রয়েডিয় থিওরি যাচাই করার জন্যে। কিন্তু ফলাফল দেখে হকচকিয়ে যান আনউইন নিজেই। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত Sex & Culture বইতে দীর্ঘ এ গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন তিনি। বিভিন্ন সভ্যতা ও সেগুলোর পতনে আনউইন দেখতে পান একটা স্পষ্ট প্যাটার্ন– . কোনো সভ্যতার বিকাশ সেই সভ্যতার যৌনসংযমের সাথে সম্পর্কিত। যৌনতার ব্যাপারে কোনো সমাজ যত বেশি সংযমী হবে তত বৃদ্ধি পাবে বিকাশ ও অগ্রগতির হার। সহজ ভাষায় বললে, সভ্যতার বিকাশের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা স্বাভাবিক যৌনাচার আবশ্যিক। প্রাথমিক বিকাশের পর্যায়ে যৌনাচারের ক্ষেত্রে প্রতিটি সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি থাকে অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত এবং এর ভিত্তি পারস্পরিক বিশ্বস্ততা। . বিস্মিত আনউইন আবিষ্কার করলেন, সুমেরিয়, ব্যাবলনীয়, গ্রিক, রোমান, অ্যাংলো-স্যাক্সনসহ প্রতিটি সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে এমন সময়ে যখন যৌনসংযম ও নৈতিকতাকে এসব সমাজে কঠোরভাবে মেনে চলা হতো। কিন্তু উন্নতির সাথে সাথে প্রতিটি সভ্যতায় শুরু হয় অবক্ষয়। সফলতা পাবার পর সভ্যতাগুলো হারানো শুরু করে নিজেদের নৈতিকতা। সাফল্যের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে তাদের মূল্যবোধ, প্রথা ও আচরণ। ক্রমেই উদার হতে শুরু করে যৌনতার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি। বহুগামিতা, সমকামিতা, উভকামিতার মতো ব্যাপারগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে এগুলোকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করে নেয় সমাজ। সামষ্টিক কল্যাণের ওপর ব্যক্তি স্থান দেয় তার নিজস্ব স্বার্থপর আনন্দকে। . যৌনাচার ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার, সমাজে এর কোনো নৈতিক বা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না–আজকের আধুনিক সভ্যতার আধুনিক মানুষগুলোর মতো এ মিথ্যে কথাটা বিশ্বাস করেছিল আগের সভ্যতাগুলোও। অবধারিতভাবেই একসময় সবার ভুল ধারণা ভাঙে, কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে যায় অনেক। একবার শুরু হয়ে গেলে আর থামানো যায় না অবক্ষয়ের চেইন রিঅ্যাকশান। অবাধ, উচ্ছৃঙ্খল যৌনাচারের সাথে সাথে কমতে থাকে সামাজিক শক্তি। কমতে থাকে সভ্যতার রক্ষণাবেক্ষণ ও উদ্ভাবনের সক্ষমতা। ক্রমশ কমতে থাকে সমাজের মানুষের সংহতি, দৃঢ়তা ও আগ্রাসী মনোভাব। আর একবার এই অবস্থায় পৌঁছবার পর সভ্যতার পতন ঘটে দুটি উপায়ের যেকোনো একটির মাধ্যমে–অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা অথবা আগ্রাসী শত্রুর আক্রমণ। . আনউইন উপসংহার টানেন, বিয়ে-পূর্ববর্তী ও বিয়ে-বহির্ভূত যৌনতা এবং অবাধ ও বিকৃত যৌনাচার যে সমাজে যত বেশি সে সমাজের সামাজিক শক্তি তত কম। যৌনতার ওপর যে সমাজ যত বেশি বাধানিষেধ আরোপ করে, তার সামাজিক শক্তি তত বাড়ে। এবং সবচেয়ে শক্তিশালী সমাজ হলো যেখানে যৌনতা এক বিয়েকেন্দ্রিক পরিবারের (Heterosexual Monogamy) মধ্যে সীমাবদ্ধ। আনউইনের মতে ৫,০০০ বছরের ইতিহাসজুড়ে, প্রতিটি সভ্যতা ও সমাজের ক্ষেত্রে এ কথা সত্য। . ‘যেকোনো সমাজকে সামাজিক শক্তি অথবা যৌন স্বাধীনতার মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে। আর এর পক্ষে প্রমাণ হলো কোনো সমাজ এক প্রজন্মের বেশি এ দুটো একসাথে চালিয়ে যেতে পারে না।’ . আনউইনের এই উপসংহারকে বিভিন্নভাবে হয়তো ব্যাখ্যা করা সম্ভব, তবে ফিতরাহর ওপর থাকা সুস্থ চিন্তার কোনো মানুষের জন্য সত্যটা স্পষ্ট। এই উপসংহার বিস্ময়কর–বিস্ময়ের কারণ হলো এত দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসে, স্থান-কাল-পাত্রভেদে একই চক্রের পুনরাবৃত্তি চলছে। কিন্তু এ উপসংহার অপ্রত্যাশিত না। আসুন দেখা যাক, আনউইনের গবেষণা থেকে আসলে আমরা কী কী জানতে পারছি। . সমাজে ফাহিশা (অশ্লীলতা ও বিকৃতি) ও যিনা বাড়লে ভাঙন ধরে পরিবার এবং মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোতে। এর প্রভাব পড়ে সামাজিক সংহতি এবং সমাজের অন্তর্নিহিত নৈতিক শক্তির ওপর। ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়তে শুরু করে সমাজ। প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই সমাজ ও সভ্যতাকেও নিয়ন্ত্রণ করে অপরিবর্তনীয় কিছু নিয়মাবলি। পার্থক্য হলো প্রকৃতির ক্ষেত্রে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এই নিয়মগুলোর অস্তিত্ব আমরা ধরতে পারি। সমাজ-রাষ্ট্র-সভ্যতার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অতটা সহজ হয় না। কিন্তু যিনি জোয়ার-ভাটা, দিন-রাত, শীত-গ্রীষ্মের নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তিনিই বেঁধে দিয়েছেন মানবসমাজ ও সভ্যতার নিয়মগুলোও। আর তাই এই নিয়ম ভঙ্গ করার পরিণতি আছে। . নৈতিকতা, যৌনতার ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নির্ধারিত বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করা, তার অবাধ্য হওয়া শুধু ব্যক্তির ওপর প্রভাব ফেলে না; বরং প্রভাব ফেলে পরিবার, সমাজ ও প্রজন্মের ওপর। এর মূল্য চোকাতে হয় সবাইকে। আল্লাহ অনুমোদন দেননি এমন যেকোনো যৌনাচারে লিপ্ত হওয়া ও মেনে নেয়া নিস্তেজ করে সমাজের উদ্যম, অনুপ্রেরণা ও আধ্যাত্মিক শক্তিকে। শুরু হয় এক চেইন রিয়্যাকশন। ক্রমশ বেড়ে চলা বিকৃতির প্রতি শূন্য হতে শুরু করে মানুষ অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া। এক সময় বিকৃতি পরিণত হয় প্রচলন ও প্রথায় । .

বর্তমান

.

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। কিন্তু বোকা মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। চিনতে পারে না অবক্ষয়ের কালে সভ্যতার পচন ও আসন্ন পতনকে। . আজ বিশ্বজুড়ে যে যৌন উন্মাদনা, বিভিন্ন ধরনের যৌনবিকৃতির স্বাভাববিকীকরণ, আদর্শিক ও আইনি বৈধতা দেয়ার প্রবণতা আমরা দেখছি তা ইঙ্গিত দেয় সেই একই পরিণতির পুনরাবৃত্তির। অন্য সভ্যতাগুলোর মতোই আমাদের এ যৌন উন্মাদনা হলো সভ্যতার অবক্ষয় ও আসন্ন পতনের চিহ্ন। বিশেষ করে পুরুষত্বের ধারণাকে আক্রমণ করা এবং অ্যান্ড্রোজিনির (হাল আমলের ট্র্যান্সজেন্ডার আন্দোলন) এর দিকে যাবার প্রবণতা চরম পর্যায়ের অবক্ষয়ের চিহ্ন। . বর্তমান সময়ের পশ্চিমের ট্র্যান্সজেন্ডার উন্মাদনা নিয়ে খুব সুন্দর বলেছেন ক্যামিল পা’লিয়া। মহিলার প্রথম বই ছিল পশ্চিমা সভ্যতার শিল্পের ইতিহাসে অবক্ষয়–বিশেষভাবে যৌন অবক্ষয় নিয়ে। [1] পা’লিয়ার মতে প্রত্যেক বড় বড় সভ্যতার মধ্যে এ চক্র দেখতে পাওয়া যায়। সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে মহিমান্বিত করা হয় পুরুষত্বকে। কিন্তু অবক্ষয়ের পর্যায়ে সমাজ, শিল্প ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেতে শুরু করে পুরুষত্বের বদলে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য। রোমান সভ্যতার শুরুর দিকের ভাস্কর্যগুলো যুদ্ধংদেহী, অ্যালফা-মেইল (Alpha Male)। শেষের দিকে জয়জয়কার আঁকাবাঁকাভাবে দাঁড়ানো মেয়েলি ডেইভিডদের। বিভিন্ন সভ্যতার ক্ষেত্রে এই প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি হয়। অবক্ষয়ের পর্যায়ে এসে সভ্যতাগুলোর মধ্যে পুরুষত্ব, পরিবার, যৌনসংযমের বদলে মহিমান্বিত করা হয় যৌনবিকৃতিকে। হঠাৎ করে বিস্ফোরণ ঘটে সমকামিতা, উভকামিতা, অজাচার, পশুকামিতা, স্যাইডোম্যাসোকিযম, বন্ডেজ, জেন্ডার গেইমসসহ বিভিন্ন যৌনবিকৃতির। বিকৃত আচরণগুলো অর্জন করে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। . অবশ্য ওই সভ্যতার মানুষ এগুলোকে অবক্ষয় ও পতনের চিহ্ন হিসেবে দেখে না; তাদের কাছে এগুলোকে মনে হয় নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ আর সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গির ফসল। অ্যারিস্টোক্র্যাটিক, অভিজাত মুক্তচিন্তা। যৌনতার ব্যাপারে এমন মুক্তবাজারি দৃষ্টিভঙ্গিকে তারা সংজ্ঞায়িত করে প্রগতি আর উন্নতির নামে। এটাকেই তারা মনে করে সভ্যতার মাপকাঠি। কিন্তু ঐতিহাসিক দূরত্ব থেকে দেখা যায়, এই সভ্যতা আসলে তার নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়া সভ্যতা এবং এ সভ্যতার নাগরিকেরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাচ্ছে নিজ শরীর ও সত্তার ব্যাপারে। এ সভ্যতা নিজের পুরুষত্বকে প্রশ্ন করছে, প্রশ্ন করছে নিজের পরিচয়কে। যা কিছুর মাধ্যমে সভ্যতা একসময় মাহাত্ম্য অর্জন করেছিল, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া তার ছিটেফোঁটা এখনো রয়ে গেছে, কিন্তু অবক্ষয়কালের মানুষ হারিয়ে ফেলেছে এর সাথে সব সম্পর্ক। . পশ্চিমের বর্তমান অবস্থার ক্ষেত্রে কথাগুলো খাপে খাপে মিলে যায়, আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার ক্ষেত্রে ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটছে। এ অবক্ষয়ের শুরুটা হয়েছে সেক্সুয়াল রেভুলুশানের মাধ্যমে যখন একটি প্রজন্ম নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দিক দিয়ে প্রায় সম্পূর্ণভাবে আগের প্রজন্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এবং সব ধরনের বাঁধন খুলে ফেলে যৌনতাকে দিয়েছে মানুষের ওপর অনিয়ন্ত্রিত রাজত্ব। পশ্চিমে এ ব্যাপারটা ঘটেছে ষাট ও সত্তরের দশকে। আর আমাদের মতো ‘মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাওয়াদের’ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটছে এখন। যার সাক্ষ্য দেয় আমাদের সমাজে এখন চলা যিনা, গর্ভপাত, পরকীয়া, সমকামিতা, পর্নোগ্রাফি এবং ধর্ষনের নীরব মহামারী। . এ সভ্যতা, যা আমরা মুসলিমরা বেছে নিইনি, যা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে–আমরা ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় যাকে ভালোবাসতে এবং এ ভালোবাসাকে উন্নতি ও প্রগতি মনে করতে শিখেছি–তা আজ ধ্বংসের দোরগোড়ায়। ৫,০০০ বছরের ইতিহাস তা-ই বলে। পতনোন্মুখ এক সভ্যতার শেষ প্রান্তে অবস্থান করছি আমরা। পেছনে তাকিয়ে দেখুন। দেখুন ব্যাবিলন, মিসর, গ্রিস, রোম আর বাইনযেন্টাইনের ইতিহাস। পুনরাবৃত্তি হচ্ছে সেই একই চক্রের, একই প্যাটার্নের। কিন্তু আমরা নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত, এত অসুস্থভাবে আত্মকেন্দ্রিক, আত্মপরিচয়ের সংকটে এতটাই নিমগ্ন যে, পচনের গন্ধ আমরা টের পাই না। পতনের শব্দ শুনতে পাই না। বর্তমানমুগ্ধতা আর ক্ষমতার উপাসনা করার প্রবণতা অন্ধ করে রেখেছে আমাদের। আমরা এত কাছে দাঁড়িয়ে আছি যে ক্যানভাস, কাগজ আর রঙের খুঁটিনাটি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু মূল ছবিটা দেখতে পারছি না। আমাদের ঘোরলাগা চোখে রঙের বিস্ফোরণ ধরা পড়ে, কিন্তু ধরা দেয় না বাস্তবতার অবয়ব। . এ সভ্যতার সাথে মানিয়ে নেয়ার আমাদের সব ‘সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম’ চেষ্টা, যেগুলোকে আমরা ‘প্রগতি’ আর ‘বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ’ বলি–পশ্চিমের অনুকরণ, পশ্চিমের ছাঁচে ইসলামকে নতুনভাবে ফ্রেইম করা, সবকিছুকে ধরে ধরে ইসলামীকরণ করার আমাদের মহাকৌশলী পরিকল্পনা, ‘ইসলামী’ গণতন্ত্র আর ব্যাংকিংয়ের মতো ধারণাগুলোর বৈধতা দেয়ার কূটতর্কের কারুকাজ, পদে পদে পশ্চিমের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে নিজেকে বদলে ফেলা–এসবই হলো এমন এক দালানকোঠার দেয়াল রং করার মতো, যা এরই মধ্যে আগুনে পুড়ে ধসে পড়তে শুরু করেছে। .

ভবিষ্যৎ

. চূড়ান্ত পরিণতি কী?

কী অপেক্ষা করছে এ সভ্যতার জন্য? . আমরা অবশ্যই ভবিষ্যৎ জানি না, কিন্তু ৫,০০০ বছরের ঐতিহাসিক প্যাটার্ন থেকে একটা ধারণা করা যায়।

১) অরাজকতাপূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিল্পব ও বিশৃঙ্খলা, অথবা ২) অধিকতর সামাজিক শক্তির অধিকারী আগ্রাসী শত্রুর আক্রমণ . যৌনাচারের ব্যাপারে যে দৃষ্টিভঙ্গি আমরা এখন দেখছি অবধারিতভাবেই তা এমন এক বিভ্রান্ত প্রজন্মের জন্ম দেয় যারা না নতুন কিছু সৃষ্টি পারে, আর না পারে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে। অবক্ষয়, অবনতি, অরাজকতা, অযোগ্যতা আর ভীতসন্ত্রস্ত নিষ্ক্রিয়তার এক চক্রে আটকা পড়ে সভ্যতা। আত্মপরিচয়ের সংকটে ঘুরপাক খাওয়া আত্মরতিতে নিমগ্ন ভোগবাদী প্রজন্মের ঘোরলাগা চোখের সামনে খুলে আসে সমাজের বাঁধন। ধসে পড়তে শুরু করে সভ্যতা। . অথবা এমন কোনো জাতির আবির্ভাব ঘটে যারা ত্বরান্বিত করে একসময়কার শক্তিশালী ও গর্বিত কিন্তু বর্তমানে অধঃপতিত জাতির পতনকে, পরিপূর্ণ করে ধ্বংসপ্রক্রিয়াকে। বারবেরিয়ান, ভিসিগথ, হান, মঙ্গোল, ষষ্ঠ শতাব্দীর আরব বেদুইন। . আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার অবক্ষয়কালে কারা হবে এই আগ্রাসী বাহ্যিক শত্রু? . আধুনিক পশ্চিমা ঐতিহাসিক এবং সমাজবিজ্ঞানীদের বহু আগেই সভ্যতার পালাবদল আর জাতিগুলোর উত্থানপতনের চক্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ইসলামী ইতিহাসের মহিরুহ ইবনু খালদুন। আগ্রাসী ও বিজয়ী জাতির বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তাঁর অবিস্মরণীয় রচনা আল-মুক্কাদিমাতে। . ইবনু খালদুনের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা হলো সামাজিক সংহতি। এটি হলো সেই বন্ধন যা একটি সমাজের মানুষের মধ্যে তৈরি করে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহায়তার মনোভাব। এ বন্ধন মানুষকে জোগায় প্রতিকূলতার মোকাবেলা আর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি। সাধারণত এ বন্ধন সবচেয়ে শক্তিশালী হয় গোত্রীয় সমাজগুলোতে। কারণ, এ সমাজগুলোর ভিত্তি হয় রক্ত-সম্পর্ক এবং আত্মীয়তার বন্ধন। তবে এরচেয়েও শক্তিশালী বন্ধন হলো ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ, যার মাধ্যমে আল্লাহর ইচ্ছায় খুব অল্পসংখ্যক মুসলিমরা পরাজিত করতে পেরেছিলেন গোত্রীয় আরব মুশরিকদের। সামাজিক সংহতির এ ধারণার আলোকেই ইতিহাসের চক্রকে ইবনু খালদুন ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, . শক্তিশালী সামাজিক সংহতি-সম্পন্ন জাতি আক্রমণ করে বিলাসব্যসনে মগ্ন, আধুনিক, শহুরে সভ্যতাকে। অধিকাংশ সময় এ আক্রমণকারীরা হয় রুক্ষ, যাযাবর, দরিদ্র। তাদের থাকে শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বন্ধন, অধিকতর প্রাণশক্তি, মনোবল এবং তুলনামূলকভাবে অল্প বৈষয়িক সম্পদ। অন্যদিকে প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক হলেও জীবনের প্রতি নির্লিপ্ত উদাসীনতা আর আধ্যাত্মিক আলস্যে ভোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠী। নিজেদের রক্ষা করার মতো সামাজিক সংহতি আর যুদ্ধংদেহী মনোভাব থাকে না তাদের। সুবিধাজনক শহুরে স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনে এসবের প্রয়োজনও হয় না। তারা ব্যস্ত থাকে সস্তা সুখের নানা আয়োজনে, ভোগ আর অবক্ষয়ে। . অবধারিতভাবেই আক্রমণকারীরা বিজয়ী হয়, স্থাপন করে নিজেদের আধিপত্য। তারপর একসময় তারাও গা ভাসিয়ে দেয় সহজ জীবনের সহজিয়া আনন্দের স্রোতে। ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে তাদের সংহতি আর নৈতিক শক্তি, ভাঙন ধরে সমাজে। দিগন্তে উদয় হয় নতুন কোনো জাতি, নতুন কোনো আক্রমণকারী। চলতে থাকে পালাবদলের চক্র। . ইবনু খালদুন এর ভাষায়,

‘...বিলাসব্যসন চরিত্রের মধ্যে নানা প্রকার দোষ, শৈথিল্য ও বদভ্যাসের জন্ম দেয়... সুতরাং তাদের মধ্য থেকে সেই সচ্চরিত্র অন্তর্হিত হয়, যা একসময় তাদের রাজ্য প্রতিষ্ঠার যোগ্য গুণ ও নিদর্শন হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। তা ত্যাগ করে তারা যখন অসৎ চরিত্রে সুসজ্জিত হয়ে ওঠে, তখন স্বভাবতই ক্ষয় ও দুর্বলতার লক্ষণ প্রকাশ পায়। আল্লাহর সৃষ্টিতে এ নিয়মই বিদ্যমান। ফলে সাম্রাজ্যে ধ্বংসের প্রারম্ভ সূচিত হয়ে তার অবস্থা বিশৃঙ্খল হয় ওঠে এবং তার মধ্যে ক্ষয়ের সেই সুপ্রাচীন ব্যাধি দেখা দেয়, যাতে মৃত্যু ঘনিয়ে আসে।’ [2] . নগরবাসীরা সর্বপ্রকার আমোদ-প্রমোদ, বিলাসব্যসন, পার্থিব উন্নতি লাভের আশা ও তাকে ভোগ করার স্পৃহা দ্বারা বেষ্টিত থাকে। এর ফলে তাদের জীবাত্মা অসৎ চরিত্র ও অন্যায় প্রসঙ্গের মধ্যে কলুষিত হয়ে ওঠে। এভাবে তারা যতই তাতে নিমজ্জিত হয়, ততই সৎপথ ও ন্যায়পন্থা থেকে দূরে সরে যায়। এমনকি এর ফলে তাদের মধ্যকার সংযমের আচার-আচরণও তাদের অবস্থাগুলোতে দুর্নিরীক্ষ্য হয়ে ওঠে। [3] . (বর্বর গোত্রগুলো) প্রাধান্য বিস্তারে অধিকতর ক্ষমতাশালী এবং অন্যদের নিকট যা কিছু আছে, তা ছিনিয়ে নিতে অধিকতর পারঙ্গম। যখনই তারা প্রাচুর্যের সাথে পরিচিত হয় এবং সচ্ছলতার মধ্যে জীবনের ভোগ-সম্ভোগে লিপ্ত হয়, তখনই তাদের প্রান্তরবাস ও বন্যপ্রকৃতি হ্রাস পাওয়ার অনুপাতে তাদের শৌর্যবীর্যও হ্রাস পায়। [4] . ইবনু খালদুনের এ বিশ্লেষণ থেকে বিজয়ী জাতির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। তারা হবে অধিকতর সামাজিক সংহতি, নৈতিক ও প্রাণশক্তির অধিকারী। অতি সংবেদনশীল আধুনিক রুচির বিচারে সম্ভবত একটু বেশি রুক্ষ ও কর্কশ। আমাদের কাছে তাদেরকে মনে হতে পারে পশ্চাৎপদ, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সাদামাটা এমনকি উগ্র। মূল্যবোধ ও যৌনতার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তারা কঠোর সংযমী, কট্টর। সভ্যতার বিলাসব্যসন, অবক্ষয় ও অধঃপতনের বিষ থেকে মুক্ত। যুদ্ধংদেহী, বেপরোয়া, লড়াকু, কষ্টসহিষ্ণু। . এখানে যে বিষয়টা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, অধঃপতিত সভ্যতাকে যারা জয় করে তারা চারিত্রিক দৃঢ়তা, অধিকতর সংহতি ও সামাজিক শক্তির কারণে বিজয়ী হয়। নিছক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ, অর্থনীতি কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর হবার কারণে না। তাদের বিজয়ের কারণ হলো ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার ব্যাধি থেকে মুক্ত হওয়া। এ কারণেই অ্যামেরিকার পতনের পর বিশ্বমঞ্চে প্রধান শক্তি ও নতুন সাম্রাজ্য হিসেবে চীন কিংবা রাশিয়ার আবির্ভাবের ব্যাপারে অনেকের প্রচার করা ও পছন্দের বিশ্লেষণ ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত প্যাটার্নের সাথে মেলে না। অ্যামেরিকার পতন হলে চীন এবং রাশিয়ার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব নিঃসন্দেহে বাড়বে। একটা সময় পর্যন্ত, একটা নির্দিষ্ট মাত্রায়। কিন্তু শতবর্ষের নতুন সাম্রাজ্য ও সভ্যতা তারা গড়ে তুলবে পারবে বলে মনে হয় না। সভ্যতার পতন ও রূপান্তরের পর্যায়ে বড়জোর সাময়িক একটা ভূমিকা থাকতে পারে তাদের। কারণ, যে দুর্বলতাগুলো আধুনিক পশ্চিমে বিদ্যমান সেগুলো বিদ্যমান চীন এবং রাশিয়াতেও। এ যৌনবিকৃতি, এ উন্মাদনা, সামাজিক সংহতি ও শক্তির এ দারিদ্র্য থেকে তারা মুক্ত না। আজকের চীন এবং রাশিয়াকে আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার চেয়ে মৌলিকভাবে আলাদা বলা যায় না। চীন ও রাশিয়া আধুনিক পশ্চিমের মতো ইউরোপীয় শেকড় থেকে বের হয়ে আসেনি, তাদের আছে হাজার বছরের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এটুকু পার্থক্য আছে। কিন্তু এ পার্থক্য কেবল সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত। আদর্শ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে বস্তুবাদী, ভোগবাদী, আত্ম-উপাসনায় মগ্ন আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার অধিবাসীদের সাথে চীন কিংবা রাশিয়ার খুব বেশি পার্থক্য নেই। তাই যুক্তি বলে এভাবে চললে তাদের পরিণতিও অভিন্ন হবার কথা। . একইভাবে এ বিশ্লেষণ অনুযায়ী পশ্চিমের চিন্তা ও পদ্ধতিগত অনুকরণ করে চলা মুসলিমবিশ্বের বিভিন্ন আন্দোলনগুলোর কাছ থেকেও বিজয়ের আশা করা যায় না। কারণ, এ আন্দোলনগুলো সভ্যতার ব্যাধি থেকে মুক্ত না, হতেও চায় না। বরং এ ধরনের চিন্তার লক্ষ্য হলো আরও বেশি করে চলমান বিশ্বব্যবস্থার সাথে খাপ খাওয়ানো, সিস্টেমের অংশ হওয়া। তারা সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম না। এবং ধীরে হলেও তারাও একসময় অবধারিতভাবে আক্রান্ত হবে সভ্যতার সুপ্রাচীন ব্যাধিতে। যার অনেক বাস্তব প্রমাণ এখনই আমরা দেখতে পাচ্ছি। . আবারও বলছি, আমরা ভবিষ্যৎ জানি না; গ্বাইবের জ্ঞান কেবল আল্লাহরই। ইবনু খালদুনসহ অন্যান্য ঐতিহাসিকদের তুলে ধরা বিশ্লেষণ সভ্যতার পালাবদলের ব্যাপারে আমাদের একটা জেনারেল থিওরি দেয়। কিন্তু প্রতিটি জাতির উত্থানপতন আর ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকের পেছনে সক্রিয় থাকে আরও অনেকগুলো ফ্যাক্টর। তাই মূল তত্ত্ব থেকে এদিক-সেদিক হতে পারে, হওয়াটাই স্বভাবিক। কিন্তু সার্বিকভাবে এ প্যাটার্ন টিকে থাকার কথা। সেই সাক্ষ্যই দেয় ৫,০০০ বছরের ইতিহাস। পাশাপাশি ৩০ বছরের ব্যবধানে আধুনিক চোখে রুক্ষ, উগ্র, যাযাবর, পশ্চাৎপদ কিছু মানুষের হাতে পরপর তিনটি যুদ্ধে আমাদের সময়ের দু-দুটো সুপারপাওয়ারের বিস্ময়কর পরাজয়ও সভ্যতার এ অমোঘ পালাবদলের প্রাথমিক পর্বের ইঙ্গিত দেয় কি না, সে প্রশ্নও করা যায়। . আল্লাহর নির্ধারিত সিদ্ধান্ত আসার আগে এ প্রশ্নগুলোর নিশ্চিত কোনো উত্তর দেয়া সম্ভব না। বাস্তবতার আলোকে নিজস্ব বিবেচনাবোধ অনুযায়ী সম্ভাব্য উত্তরগুলো থেকে যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে আমাদের। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, পতনের কালে বেঁচে আছি আমরা। আমরা বেঁচে আছি মহাকাব্যিক পটপরিবর্তনের সময়ে, যখন সবকিছু ভেঙে পড়ে আর তারপর ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে ওঠে নতুন সভ্যতার নতুন সৌধ। কালের অমোঘ স্রোতে হারিয়ে জেতে না চাইলে ইতিহাসের ভাঙাগড়ার এ পর্বে, এ অবক্ষয়কালে একটা পক্ষ আমাদের বেছে নিতেই হবে। .

[1] Sexual Personae, Camille Paglia (1990) [2] ‘রাজশক্তির স্বভাব যখন গৌরব, বিলাসব্যসন ও স্থিরতায় সুদৃঢ় হয়, তখনই সাম্রাজ্যে ক্ষয় দেখা দেয়’,আল মুকাদ্দিমা, ইবনু খালদুন। [3] ‘প্রান্তরবাসীরা নগরবাসীদের অপেক্ষা সততায় অধিকতর নিকটবর্তী’, প্রাগুক্ত [4] ‘বর্বর জাতিগুলো প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষেত্রে অন্যান্য জাতি অপেক্ষা অধিকতর ক্ষমতাবান’, প্রাগুক্ত

. লেখক- আসিফ আদনান **বই- চিন্তাপরাধ **. বইটি অনলাইনে অর্ডার করার লিঙ্ক - ১) রকমারি- https://bit.ly/2VqfRsn ২) ওয়াফি লাইফ- https://bit.ly/2Hq1ocd