Published on

নীল নকশা (চতুর্থ কিস্তি)

বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম।

IMUN (International Model United Nations) এর সোশ্যাল নাইটের কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে গানের তালে তালে পার্টিসিপেন্টদের ল্যাপড্যান্স দিতে, কিংবা স্ট্রিপারদের অনুকরণে নাচতে দেখা যাচ্ছে। বেশ সমালোচনা হচ্ছে। অনেক কথা হচ্ছে কিভাবে এগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে পশ্চিমা কালচার ঢোকানো হচ্ছে, কেন এগুলো বাংলাদেশের সমাজের সাথে যায় না – সেটা নিয়ে । সম্ভবত আজকে দুপুর থেকে এ কাজগুলোকে ডিফেন্ড করে পোস্ট আসতে শুরু করবে। সেগুলোতে বলা হবে, কিভাবে এসব আসলে চিন্তার স্বাধীনতা সংস্কৃতি চর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যতোক্ষন না আপনার আনন্দ আরেকজনের কষ্টের কারণ হচ্ছে, ততক্ষণ আপনি যা ইচ্ছে করতে পারেন, সমস্যা কোথায়? এটা জাস্ট এন্টারটেইনমেন্ট, ফান, লিবার্টি। এ অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত কেউ একজন সম্ভবত অলরেডি এমন কিছু বলেছে। অন্যরাও বলবে। . তারপর আমরা আরেকদলকে আসতে দেখবো - ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি অমুক অমুক কাজটা সমর্থন করি না, কিন্তু আরেকজনের পছন্দ, সিদ্ধান্ত ও স্বাধীনতাকে সমর্থন করি...’ টাইপ যুক্তি নিয়ে। তৃতীয় আরেকদল আসবে, ‘কাজটা ঠিক হয়নি এবং বন্ধ হওয়া উচিত, তবে মডেল ইউএন এর বিরোধিতার কোন মানে নেই। বাংলাদেশের মতো জায়গায় এটার গুরুত্ব অনেক। হয়তো এর মাধ্যমে তরুণরা সুস্থ রাজনীতির চর্চা শিখবে। এটার অমুক তমুক ভালো দিক আছে...’ ইত্যাদি কথা নিয়ে। . নানা দলের কথা আসার আগে কিছু কথা বলে নেই। . প্রথমত, ‘বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতির সাথে যায় না’ যুক্তিটা দয়া করে বাদ দিন। বেইসিকালি এটার অর্থ হল হূমায়ুন আহমেদের গল্পের নায়ক-নায়িকাদের করা যিনা আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির সাথে যায়, কিন্তু সালমান মুক্তাদিরের কাজকর্ম যায় না। তাই সালমান মুক্তাদিরের যিনা ও ফাহিশাহর প্রমোশান খারাপ, হূমায়ুন আহমাদেরটা ভালো। শাড়ী-পাঞ্জাবী পরে মোমবাতি হাতে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে ছেলেমেয়ে একসাথে সোশ্যাল নাইট কাটিয়ে দিলে তাতে কোন সমস্যা থাকতো না। এটা একটা ননসেন্সিকাল কনসেপ্ট। সংস্কৃতি-সমাজ কোন অ্যাবসোলিউট মানদন্ড না এবং এগুলো অপরিবর্তনীয় না। ২০ বছর আগে মেয়েদের জিন্সের প্যান্ট আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির সাথে ‘মানাতো না’, এখন সম্ভবত জিন্স- ফতুয়া সাংস্কৃতিক –টাইপদের ইউনিফর্ম হয়ে গেছে। ১০ বছর পর স্কার্ট আর ব্লাউয হয়তো হবে। যা বলতে চাচ্ছি তা হল, সমাজ ও সংস্কৃতির মতো পরিবর্তনশীল মানদন্ডলে ওপর নৈতিকতা, শালীনতা ও আচরণের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। আর দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ড্রয়িং রুমে বসে সবাই মিলে টিভিপর্দায় দেখা কাজগুলো একদিন বাস্তবে উঠে আসতে পারে এ সম্ভাবনা কি একেবারেই আপনার মাথায় আসেনি? . দ্বিতীয়ত, যে ব্যাপারটা সামনে এসেছে সেটা বেশ স্থূল উদাহরণ তবে সত্যিকার অর্থে মডেল ইউএন, ইয়ুথ লিডারশীপ, মুভ ফাউন্ডেশানসহ এ জাতীয় বিভিন্ন সংস্থা এবং তাদের ওয়ার্কশপের মূল কাজটার বাস্তব রূপ আসলে এটাই। শুনতে ভালো এমন কিছু কথা, এবং দেখতে ভালো এমন কিছু কাজের আড়ালে সুনির্দিষ্ট কিছু চিন্তা সমাজের কিছু মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া। এ মানুষগুলো তারপর নিজ থেকেই সমাজে এসব ধারণা ছড়িয়ে দেবে। সেটা হতে পারে নারী অধিকার, মানবতা, ইন্টারফেইথ, স্বাধীনতা, ব্যাক্তি স্বাধীনতা কিংবা মুক্তচিন্তার মতো কনসেপ্ট যেগুলো, ভালো শোনায় এবং যেগুলোর শাব্দিক পোশাক তাদের মূল অর্থকে খুব সুন্দরভাবে আড়াল করে রাখে। যারা এসবে অংশগ্রহণ তাদের বেশিরভাগই এতোকিছু জেনেবুঝে যায় না, এবং নিজের অজান্তেই চেইঞ্জ এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতীয় ব্র্যান্ডের উগ্র ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া অনেকেই ইসলামকে বদলে দেয়ার অ্যামেরিকান ব্র্যান্ডের এই সূক্ষ এজেন্ডার বিরোধিতা করা তো দূরে থাকুক, বরং সমর্থক কিংবা সক্রিয় অংশগ্রহণকারীতে পরিণত হয়। একারণেই মাদ্রাসার ছাত্ররা মুভ ফাউন্ডেশানের অনুষ্ঠানে গিয়ে দাত বের করে তেলতেলে হাসি দেয়, 'কিভাবে সমন্বিতভাবে মুভ করা যায়' সেটা নিয়ে মুভ ফাউন্ডেশানের ওয়ার্কশপে গিয়ে ইসলামী বই প্রকাশকরা ব্রেইনস্টর্মিং করে, অনেক ইসলামিস্ট সেলিব্রিটি মডেল ইউএন টাইপ ব্যাপারগুলোতে অংশগ্রহণ করে কারণ ১) সিভিতে কাজে লাগবে, ২) নেটওয়ার্কিং হবে, ৩) বিতর্কের দক্ষতা আর পাবলিক স্কিলস বাড়বে, ৪) ফ্রি-তে বিদেশ ঘুরে আসা যাবে। . তৃতীয়ত, এটা চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা চর্চার সংস্কৃতির বাস্তব প্রতিফলন – একথা পুরোপুরি সত্য। হার্ম প্রিন্সিপাল অনুযায়ী এ কাজে কোন ভুল নেই। ছেলেপেলের মজা লাগছে, শরীর গরম হয়েছে, তাই একটু-আধটু ফান করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হল তারা অন্য কারো ক্ষতি করেনি, কোন আইন না ভাঙ্গেনি – তাহলে এতে সমস্যা কোথায়? আপনার ভালো না লাগলে আপনি করবেন না। আর এখানে তো ভিডিও করাটাই অপরাধ হয়েছে, কারণ ভিডিও করা হয়েছে অনুমতি না নিয়ে। ওরা যা করেছে সেটা তো রাস্তায় মাইক লাগিয়ে করেনি। একটা ভিআইপি এরিয়াতে বন্ধ রুমের ভেতর করেছে। সমস্যা কোথায়? . যে জিনিসটাকে মাড়ির দাত দিয়ে কামড়ে ধরে নিজেদের জাতে টেনে তুলতে ইসলামিস্টদের বিশাল একটা অংশ উদগ্রীব, সেই সেক্যুলার ডিসকোর্স দিয়ে এর বিরোধিতা করা যায় না। করা গেলেও সেটা তেমন যুতসই হয় না। হবার কথাও না। ভালোমন্দের সেক্যুলার সংজ্ঞা দিয়ে এসবের বিরোধিতা করা সম্ভব না। আর ‘সমাজের সাথে যায় না’ যুক্তিও চরমভাবে দুর্বল। এসব কথা দিয়ে কোন লাভ তো হয় না, মাঝখান দিয়ে এসবের উপযুক্ত ও যথাযথ আদর্শিক বিরোধিতা এবং সঠিক অবস্থান মানুষের সামনে তুলে ধরার কাজটাও হয় না। এতোসব জোড়াতালি না দিয়ে, লম্বাচওড়া তাত্ত্বিকতা দিয়ে বুদ্ধিমান সাজার চেষ্টা না করে সরাসরি আত্মবিশ্বাসের সাথে সত্য কথাটা বলুন। এ কাজগুলো খারাপ কারণ আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল এর কাছে এগুলো খারাপ। এটা হারাম কারণ ইসলামী শারীয়াহ অনুযায়ী এটা হারাম। ব্যাপারটাতো এমন না যে সাধারন মানুষ বুঝছে না যে এগুলো খারাপ। সে বুঝতে পারছে, তার কাছে এগুলো খারাপই লাগছে। কিন্তু ঠিক কী কারণে, ঠিক কোন জায়গা থেকে এর বিরোধিতা করা হচ্ছে সেটা হয়তো সে পিনপয়েন্ট করতে পারছে না। আপনি তাকে সেটা ধরিয়ে দিন। তা না করে অনর্থক অর্থহীন অনুকরণের ব্যর্থ চেষ্টায় তাকে বিভ্রান্ত করবেন না। . চতুর্থত, মূল সমস্যা এবং এর মাত্রা নিয়ে চিন্তা করা দরকার। কিছু ছেলেপেলে মদ খেয়ে নাচানাচি করেছে, রাতে একসাথে থেকেছে এর চেয়ে অনেক বেশি দুশ্চিন্তার কারণ হল তাদের মধ্যে যে আইডিওলজি ঢোকানো হচ্ছে এবং তাদের মাধ্যমে সমাজে যেসব ধ্যানধারণা প্রসার পাচ্ছে সেটা। পশ্চিমা ধাঁচের ল্যাপড্যান্সের চেয়ে পশ্চিমের অনুকরণে মানবতা, কল্যাণরাষ্ট্র কিংবা ব্যাক্তি স্বাধীনতার অনুকরণ করাটা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। শরীরে পাপ লাগে না, কিন্তু অন্তরের ময়লা পৃথিবীর সব সমুদ্রের পানি দিয়ে ধুলেও যায় না।

লিখেছেন- আসিফ আদনান

পড়ুন আগের পর্বগুলো-

নীল নকশা (প্রথম কিস্তি)- https://goo.gl/MLfx9j

নীল নকশা (দ্বিতীয় কিস্তি) http://bit.ly/2D4eOsS

'নীল নকশা' (তৃতীয় কিস্তি)