- Published on
আইটেম সং
“আইটেম সং” খুবই রক্ত গরম করা ২ টা শব্দ অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর কাছে।এর প্রবর্তক “শ্রদ্ধেয় বলিউড” ভাইজান।এ ভাইজান হইলেন সেইরাম টাকার মালিক।কিন্তু এই ভাইয়াটা একটু লম্পট ধরণের।কারণ মেয়েদের বা মহিলাদের,বাচ্চাদের বা বুড়িদের,চিকনি চামেলিদের বা পর্নস্টারদের দিয়ে যেইভাবে একের পর এক কোপ দিচ্ছেন আর আমরাও যা কোপ খাচ্ছি তাতে তো বিবেক নামের কিছু একটা কবেই বটি কাবাব হয়ে গেছে! আর পয়সা তো আসছেই আমাদের পকেট ভাঙ্গিয়ে।
আজকাল মুভির স্ক্রিপ্ট নিয়ে কেউ তোয়াক্কা করে না। মাল-মসলাটা সলিড হলেই হয়। যেই আইটেম গানের lyrics যত কাতুকুতু দেওয়ার ক্ষমতা রাখবে সেই গান তত হিট এবং মুভি দেখে যদি গলির কুকুরেরও বমি আসে।তারপরও আমাদের(ভদ্র প্রাণীদের)ওই মুভি না দেখলে তো রাতের ঘুম হারাম।
অনেক মেয়েই মনে করে যে নিজের অস্তিত্বকে জগতের কাছে চাউর করতে হলে সেক্স আপিল থাকাটা বাঞ্ছনীয়। আর না থাকাটা awkward, তাদের এই ধারণাকে আরও মদত দেয় বেহুদা আইটেম সংগুলো। “রোম্যান্স করতে গিয়ে কিঞ্চিৎ নগ্ন হলে দোষ কী?”-টাইপ মানসিকতা অনেকটাই জনপ্রিয় এসবের কারণে।
ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তো অবস্তা আরও ভয়াবহ। তারা যখন এইসব বেহুদা গান শুনছে তখন বাচ্চাকাল থেকেই এই অমানবিকতাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিচ্ছে। বাবা-মারও কোন সমস্যাবোধ করছেননা। বাচ্চা ভাল-মন্দ বিচার করবে কীভাবে যদি তাদের প্রাথমিক শিক্ষকেরাই দিশেহারা হন? প্রতিবেশী দেশের বিষ আমরাও শুষে নিয়েছি।
কার আউটফিট কতো সেক্সি,কার বাপের কত পয়সা আছে,কোন মেয়ের ফিগার সেই,কোন ছেলে কত ম্যানলি বা কে কত ভাল জব করে- এসব দিয়ে অনেক তরুণ-তরুণী নিজেদের যাচাই করতে পছন্দ করে। বলিউড বলেন আর যেই উডই বলেন এগুলো আমাদের মাঝে এক অসুস্থ ফ্যান্টাসির জগত তৈরি করে যা বাস্তবে ফলাতে গেলে আমাদের বিবেকহীনতার পথে পা ফেলতে হয় যা একজন সভ্য মানুষ কোনদিন কামনা করে না। কিন্তু বাস্তবে আদৌ আমরা মন থেকে কতটুকু সভ্য হতে চাই?
তারকারা নিজেদের যথেষ্ট স্মার্ট ও সভ্য বলে মনে করেন। তারা তাদের কাজের জন্য মানুষের সম্মান ও প্রশংসা আশা করেন। কিন্তু নিজেদের classy people হিসেবে দাবি করা এই মানুষগুলা পয়সার লোভে যখন নিজেদের মূল্যবোধকে দ্বিধাহীনভাবে নিচুতে নামিয়ে আনেন তখন তারা কি আদৌ সভ্য থাকেন?
নাকি নর্ম বা কালচার বলে উড়িয়ে দিলেই কালো সাদা আর সাদা কালো হয়ে যায়? সবচেয়ে মজার বিষয় হল, যেই দুনিয়া ও পয়সার পূজা করে তারা প্রতিনিয়ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যাচ্ছে সেই দুনিয়াই একদিন তাদের ভুলে যাবে। অশ্লীলতার তেলে গরম হওয়া দর্শকেরা তাদের কোন কাজেই আসবে না আর না তাদের পয়সা তাদের সাথে কফিনে ঢুকবে।
বলিউডে কখনো শিলা জাওয়ান হয়,আবার কখনো মুন্নির বদনাম পুরো দেশ মাতায়। এখন তো আরও কত কি! আসলে পয়সা দিলে ফেভিকল দিয়ে চিপকানো বা বেবিডল পয়দা করা কোন ব্যাপারই না। বলিউডেরই এক বাসিন্দা নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী বলেন,“আইটেম সংগুলো নিষিদ্ধ করা খুব জরুরি।টিভি যদি ফ্যামিলির বিনোদনের জন্যই ব্যবহৃত হয়,তাহলে ফ্যামিলিতে তো বাচ্চারাও থাকে।তারা এসবের বাইরে কোনকিছু শিখতে পারে না।সারাদিন এই অর্থহীন নাচ-গান দেখার পর তারা বাস্তব জীবনে কপি-পেস্ট করার চেষ্টা করে।”[১,২]
অনেক সময় টিভি খুললেই সঙ্কোচে পড়ে যেতে হয় যখন আশেপাশে বাচ্চাকাচ্চা থাকে আর বেমানানসই কিছু পর্দায় লাফিয়ে উঠে। ওদের এই বয়সের কৌতূহল যদি পজিটিভ হয় তাহলে তা উৎসাহ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে কিন্তু যদি তার উলটো হয় তাহলে তা সামলানো মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এই যুগে বিনোদনের নামে অশালীনতা ও নগ্নতা তাদের নিরীহ প্রাণগুলোকে ঝলসে খাচ্ছে।
এবার আসি একটু কঠিন প্রসঙ্গে। আজকাল টিভি কিংবা পত্র-পত্রিকায় খুবই পরিচিত একটি শব্দ হল “ধর্ষণ”। এত ধর্ষণের কাহিনী আমরা শুনে ফেলেছি যে এখন আর নতুন করে কোন মায়া-মমতা জাগে না, নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপারে বদলে গেছে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে চলতি বাসে গ্যাং রেপ এর যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যায় তা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।এছাড়াও ২০১৪ সালের মে মাসে ১৪ ও ১৬ বছরের দুই কিশোরীর গাছে ফাঁস দিয়ে ঝুলে থাকা দেহ উদ্ধার করা হয় উত্তরপ্রদেশে।২০ বছরের এক পাকিস্তানি মেয়েকেও প্রায় একই অবস্থায় পাওয়া যায়।এরা সকলেই গ্যাং রেপের শিকার।এরকম আরও অজস্র কেইস হরহামেশাই ঘটে চলছে নিজেদের আশেপাশে।
NCRB এর পরিসংখ্যান অনুসারে প্রত্যেকদিন ইন্ডিয়াতে ৯৩ জন মহিলা ধর্ষণের শিকার হন । [৩] ।আরেকটি পরিসংখ্যান অনুসারে ইন্ডিয়াতে প্রতি ২০ মিনিটে একটা করে রেপ হচ্ছে[৪] । বিশ্বের যে দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশী রেপের ঘটনা ঘটে তার প্রথম ১০ টি দেশের মধ্যে ইন্ডিয়া রয়েছে [৫,৬] ।
ইন্ডিয়াতে প্রচুর পরিমান চাইল্ড এবিউজের ঘটনা ঘটে। বিশ্বের অনেক দেশের গনমাধ্যমেই এ ব্যাপারে অনেক রিপোর্ট হয়েছে [৭,৮,৯] । এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে বেশী চাইল্ড এবিউজ হয় এমন পাঁচটা দেশের শর্টলিস্টেও রয়েছে ইন্ডিয়ার নাম [১০]
এসবের পেছনে কি আইটেম গান গুলোর কোন ভূমিকা নেই?
এগুলো কি ভেতরের পাশবিকতা টেনে বের করছে না?
পিয়ার রিভিউ এক গবেষণাপত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, যেসক আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীরা ‘আগুন গরম’ মিউজিক ভিডিও দেখে , তারা সেক্স ফ্যান্টাসিতে ডুবে থাকে, সম্পর্কের বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে সঙ্গিনীর প্রতি যৌন সহিংসতা ।[১১]
আইটেম সংগুলোতে যা দেখায় তার সারমর্ম হল এই, একটা মেয়ে টাইট পোশাক পড়ে উন্মাদ নরপশুদের সামনে হাজির হবে। তারপর শুরু হবে বিরক্তিকর এক গান যেটার লিরিক্স এর সাথে মূল ছবির তেমন কোন খাতির নাই। সাথে চলবে নাচ যা হয়তো গাছের বানরেরও হট ফেভারিট হয়ে যাবে এক সময়। মেয়েটা তখনি সফল হবে যখন সে তার ভরা যৌবন দিয়ে উপস্থিত সবাইকে মত্ত করে। এই তো কাহিনী।
এসবের পরে মহিলাদের বা মেয়েদের আসলেই কি মা-বোনের চোখে দেখা সম্ভব হয়? অথচ আজ থেকে প্রায় ১৩-১৪ বছর আগে ইন্ডিয়ান কিছু চ্যানেলই নারীদের সম্মান ও অবস্থানকে উঁচুতে তুলে ধরতে উদ্যত ছিল। সাধারণ জীবনে নারীদের মর্যাদা বাড়ানো কিংবা নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণেও মিডিয়া সক্রিয়তা দেখিয়ে ছিল।আজ তা দেখা প্রায় দুর্লভ।
বলিউডের প্রবীণ অভিনেতা ওমপুরিও মনে করেন , ভারতীয় চলচিত্রের আইটেম গানে অশ্লীলতার মাত্রা এত বেড়ে গেছে যে এটা ধর্ষণকে উৎসাহিত করে । পদ্মশ্রী পুরষ্কার জেতা এই অভিনেতা বলেন, “এখনকার হিন্দী মুভির আইটেম গানগুলো খুবই অশ্লীল । এই গানগুলোতে এমন সব ড্যান্স মুভমেন্ট আছে যা দেখে মনে হয় তারা বোধহয় সেক্সের ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে গেছে । ক্ষমা করবেন এরকম শব্দ ব্যবহার করার জন্য । কিন্তু অবস্থাটা এতটাই ভয়াবহ।
কেউ যদি তার অবদমিত যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চাই তাহলে এসব গানের সিডি কিনে তা চালিয়ে দেখলেই পারে । পুরোনো দিন গুলোতে এরকমটা ছিল না । ষাট , সত্তর এমনকি আশির দশকের মুভি গুলোতে বার, নাইটক্লাবে চিত্রায়িত যে গানগুলো দেখানো হতো সেগুলো এতটা অশ্লীল ছিল না । পুরোনো দিনগুলোতে এত ধর্ষণের ঘটনাও ছিল না । আমি নিশ্চিত , আইটেম গান গুলো ধর্ষণের ঘটনা বাড়িয়ে দিচ্ছে ।[১২]
এবারে ধর্ষণ নিয়ে রাজনীতিবিদদের কিছু বক্তব্য পেশ করা হল। রাজনীতিবিদ বাবুলাল গড় বলেন,“এটি একটি সামাজিক অপরাধ যা নারী ও পুরুষ দুইজনের উপরেই নির্ভর করে। কখনো এইটা ঠিক আবার কখনো না......অভিযোগ না আসা পর্যন্ত কিছুই করা সম্ভব না। যদি সে(মহিলা)না চায় তাহলে কারো সাহস নাই তাকে স্পর্শ করার।তাছাড়াও আইটেম নাম্বারগুলো বাজে পরিবেশ সৃষ্টি করে।” তিনি মনে করেন মেয়েদের ক্যারাটে বা জুডো শিখে রাখা উচিৎ নিজেদের সুরক্ষার জন্যে।[১৩]
বলিউড আমাদের উচ্চমাত্রার যৌনতা গলধঃকরণ করাচ্ছে। বস্তুতই, যারা আমরা এই জিনিসগুলো উপভোগ করছি তারা বলিউডের চেয়ে কোন অংশেই কম দায়ী নয়। গত দশকে এই বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ার একটাই কারণ- তা হল সমাজ তা অনুমোদন দিয়েছে। যখন এই ঝোঁক সমাজে প্রবেশ করেছিল তখনও সমাজ নির্লজ্জের মত চুপ ছিল । এমনকি আজ যখন মহিলারা নৃত্য পরিবেশনের নামে পতিতার চেয়েও জঘন্য নায়িকারা গায়ের ত্বক এবং শরীরের ভাঁজ প্রদর্শন করে যাচ্ছে আবার নিজেদের অভিনেত্রী হিসেবে দাবি করছে সমাজ তখনও চুপ ই থাকছে।
বলিউড এর এসব ‘আইটেম সং’ গুলোকে ভারত পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান যৌন নিপীড়নের ঘটনার পিছনে দায়ী করাই যায়। মিডিয়া বিশেষ করে মুভি খুবই শক্তিশালী একটি মাধ্যম । আমি আপনি সবাই কম বেশি রুপালী পর্দার বাসিন্দাদের দেখে প্রভাবিত হই , অবচেতন মনে হলেও তাদেরকে অনুসরণ করি । সালমানের মতো সিক্স প্যাক চাই আমাদের,শাহরুখের মতো রোমান্টিক হতে ইচ্ছে করে।
তো মানুষ যখন তাদের হিরো ,রোল মডেল সালমান খান কে দেখে একটি মেয়ের পশ্চাৎ দেশে চড় মারতে, আবার অক্ষয় কুমারকে দেখে একটি মেয়ের কোমরে বাজেভাবে স্পর্শ করতে যে আবার তৎক্ষণাৎ অক্ষয়ের কোলে উঠে যায়। তখন মানুষ কি এতটুকুও প্রভাবিত হবে না ?
আমাদের ঘরে ঘরে ড্রয়িং রুমে পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে আইটেম সং দেখার মতো মানসিকতা আমরা অর্জন করে ফেলেছি , গায়ে হলুদ , বিয়ে বা যেকোন পার্টি আইটেম সং ছাড়া এখন আর ঠিক জমে না , এমনকি নিজেদেরকে ধর্মপ্রাণ মুসলিম (?) হিসেবে দাবী করে এমন মানুষে ভরা এই দেশটাতেও এখন আইটেম সং দেদারসে বানানো হচ্ছে । আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি কোন দিকে
আগাচ্ছি আমরা ?
(লস্ট মডেস্টি অনুবাদ টিম কর্তৃক অনূদিত)
পড়তে পারেন-
অশনি সংকেত- https://bit.ly/2QoJTLH
আইটেম সং,শিশু নির্যাতন এবং বলিউডী দুনিয়ার ভন্ডামি - https://bit.ly/2MpWPhv
রেফারেন্স-
[৩] http://tinyurl.com/gu6fl5o
[৪] http://tinyurl.com/hy2xphf
[৫] http://tinyurl.com/zlfdcuw
[৬] http://tinyurl.com/z2x8oz7
[৭] http://tinyurl.com/gwqhbta
[৮] http://tinyurl.com/zgs665u
[৯] http://tinyurl.com/hos7vdl
[১০] http://tinyurl.com/ld4zxd9
[১১] Jennifer Stevens Aubrey, K. Megan Hopper, and Wanjiru G. Mbure, “Check That Body! The Effects of Sexually Objectifying Music Videos on College Men’s Sexual Beliefs,” Journal of Broadcasting and Electronic Media 55, no. 3 (2011): 360–379.