Published on

কেন এই বই? (১)

ছেলেটা পড়তো আমার কাছে। মনোযোগী, মেধাবী। খুব ভালো রেসাল্ট ছিল তার। করোনার মাঝে দুই বছর কোনো খোঁজ খবর নেই। একদিন শুনি হুট করে আত্মহত্যা করেছে প্রেমঘটিত ঝামেলায়। খুব খারাপ লাগলো। কিন্তু জীবনের ব্যস্ততায় কয়েকদিনের মাঝে আবার ভুলেও গেলাম।

জীবনের দীর্ঘ একটা সময় কাটাতে হয়েছে হোস্টেলে, হলে, ব্যাচেলর বাসায়। উঠাবসা হয়েছে প্রচুর কিশোর আর তরুণদের সাথে। তাই এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার কাছে নতুন না। শুরুর দিকে অবশ্য খুব শকড হতাম। মনের মধ্যে পাথরের মতো ভার হয়ে চেপে বসতো বিভিন্ন চিন্তা। কিন্তু এখন আর তেমন কিছু মনে হয় না। কিশোর তরুণদের কাছে ভাইয়া থেকে আংকেল হয়ে যাবার বয়সটাতে পা দেবার সন্ধিক্ষণে অনেক আবেগই আজ মরে যাবার পথে, বহু আগেই চিরতরে নির্বাসনে চলে গেছে অনেক কোমল অনুভূতি।

ভেবেছিলাম শুরুর লেখাটা ব্যাপক তথ্যপ্রমাণ আর পরিসংখ্যান নিয়ে এসে, সাহিত্যরস ঢেলে ঢেলে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে লিখবো। এই বইটা আমরা কেন লিখছি, কেন প্রেম নিয়ে ব্যাপক আকারে কাজ হওয়া দরকার তা প্রমাণের চেষ্টা করবো। তাই সম্পাদকের নরম, কিন্তু সূঁচের চেয়েও তীক্ষ্ণ ঝাড়ি খাবার ঝুঁকি নিয়েও অনেক সময় কাটিয়ে দিলাম শুধু লেখার প্রস্তুতি নিতে। কিন্তু লিখতে বসে কেন যেন শুধু সহজ সরল গল্প বলতে ইচ্ছা করছে। মনের মধ্যে যে গল্পগুলো বহু আগেই হারিয়ে গিয়েছিল, তারা একে একে এসে হাজির হয়ে আবদার জানাচ্ছে-আমার কথা বলতে ভুলে যেও না প্লিজ!

কতো বীভৎস গল্প বলবো?

একদিন দুপুরবেলা লাঞ্চ ব্রেকে বাসায় এসে খেতে বসেছি। পাশের রুমের ছোট ভাই ত্রস্ত পায়ে আমাদের রুমে ঢুকলো। ‘ভাই একটু আসেন’-বলেই আবার চলে গেল। কী যেন ছিল ওর চেহারায়। ভাতের প্লেট ফেলে কোনোমতে হাত ধুয়ে গেলাম ওদের রুমে। গিয়ে দেখি সে রুমের আরেক ছোট ভাই গার্লফ্রেন্ডকে ভিডিও কলে রেখে সার্জিক্যাল ব্লেইড দিয়ে হাত কাটা শুরু করেছে!

-

‘মুক্ত বাতাসের খোঁজে’ বই লেখা হয়েছে। বাসায় নতুন এক ছোট ভাই আসলো। আমার টেবিলে বইয়ের কয়েকটা কপি দেখে বললো–একটা কপি সে নিতে পারে কি না, তার এক বন্ধুকে দেবে। প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে সেই বন্ধু প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষী হয়ে গিয়েছে। গাঁজা মদের সাথে সখ্য গড়েছে। সাথে সাথে চলছে একটার পর একটা মেয়েকে “ধরে, খেয়ে ছেড়ে দেওয়া”!

-

একদিন সন্ধ্যার বাসায় ফিরে দেখি গেইটে তালা। পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম চাবি নেই। ভুলে গেছি। ছোট ভাইকে ফোন দিলাম। ওরা সবাই মিলে ঘুরতে গেছে, আসতে ১০-১৫ মিনিট লাগবে। প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিলাম। গেইটের সামনের সিঁড়িতে বসেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সামনের ফ্ল্যাটেও আমাদের মতো ব্যাচেলর থাকে। হাই হ্যালো হয়। ওদের গেইটেও তালা দেওয়া। একটু পর সিঁড়িতে ধুপধাপ সতর্ক আওয়াজ। দেখি আমাদেরই বয়সী সাজগোজ করা একটা মেয়ে উঠে আসছে। টপ ফ্লোরের সবগুলো ফ্ল্যাটে ব্যাচেলর থাকে। তাহলে এখানে মেয়ে কেন? চার-পাঁচ সেকেন্ড পরে দেখি সামনের ফ্ল্যাটেরই একটা ছেলে ঘামতে ঘামতে প্রায় উড়ে আসছে। আমাকে দেখেই সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। তারপর যন্ত্রের দক্ষতায় তালা খুলে ওর গার্লফ্রেন্ডকে ফ্ল্যাটের ভেতর নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো!

-

পরের দিন পরীক্ষা ছিল। কিছুই পড়া হয়নি। সকালে উঠে পড়তে হবে ভেবে শুয়ে পড়লাম। রাত প্রায় ২ টার দিকে ফোন আসলো এক আত্মীয়ের কাছ থেকে। উনাদের পরিচিত এক মেয়ের সাথে বয়ফ্রেন্ডের গ্যাঞ্জাম। বয়ফ্রেন্ড ফেইসবুক আইডির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঐ মেয়ের ব্যক্তিগত ছবি আপলোড করে দিয়েছে। কুৎসিত সব ক্যাপশন। সাথে ফোন নাম্বারও দিয়েছে। বিভিন্ন মানুষজন তাদের ফোন করে বাজে বাজে কথা বলছে। মেয়ে, মেয়ের বাবা-মার পাগলপ্রায় দশা! কিছু করা যায় কি না, এজন্যেই আমাকে ফোন দেওয়া। রাত ৪ টা পর্যন্ত এই সেই করে এক বড় ভাইয়ের সাহায্য নিয়ে আইডির নিয়ন্ত্রণ পাওয়া গেল। ছবি ডিলিট করে ঘুমালাম। পরীক্ষা আর দেওয়া হলো না।

-

একজন নিকটাত্মীয় মারা গিয়েছে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ চলার সময়। কবর দিতে গিয়েছি। সেখানে দেখা হলো আমাদের এলাকার এক সিনিয়র ভাইয়ের সাথে, এলাকার ক্রিকেট টিমের মেইন বোলারদের একজন ছিল সে। সে ভাই আড়াল হতেই এলাকার আর এক বন্ধুর কাছে শুনলাম–ঐ সিনিয়র ভাই পাশের বাসার গৃহবধূকে নিয়ে ভেগে গিয়েছিল কিছুদিন আগে। ঐ ভাইয়ের বাচ্চাকাচ্চা আছে, সেই গৃহবধূরও বাচ্চাকাচ্চা আছে!

-

কতো কিছু হয়ে যাচ্ছে আজকাল। এলাকায় যাওয়া হয় না তেমন। খবরও রাখা হয় না। তাই খবর পেলাম না আমাদের পাশের বাড়ির, আমাদের চেয়ে ২/৩ বছরের বড় আন্টি বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। প্রেমিক বিয়ের আশ্বাস দিয়েছিল, বিছানায় নিয়ে গিয়েছিল অনেক বার। এখন আর বিয়ে করতে রাজি নয়। আমি জানতে পারলাম না... ক্রিকেট খেলা, ফুটবল খেলা, ভলি খেলা যাকে হাতে ধরিয়ে ধরিয়ে শিখিয়েছিলাম, আমি দুই টাকার একটা বরফ খেলেও যাকে খাওয়াতাম, সেই ছোট ভাই ২ সন্তানের জননীর সাথে চুটিয়ে পরকীয়া করছে। আমি জানতে পারলাম না, আমার ছোটবেলার বন্ধু হোটেলে মেয়ে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে মাঝেমাঝেই।

-

রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি এক সন্ধ্যায়, মাগরিবের আযান দিচ্ছে। কয়েকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। বড়জোর ক্লাস ৭/৮ এ পড়ে। একজন উচ্চস্বরে সবিস্তারে বলছে কীভাবে সে তাদেরই আরেক বন্ধুর বোনকে বিছানায় নিয়ে গিয়েছিল, বিছানায় কী কী করেছিল, মেয়েটা তাকে শ্রবণ অযোগ্য কী বলেছিল...

-

এর আগে না পরে ঠিক খেয়াল নেই, তবে খুব কাছাকাছি সময়ের ঘটনা... বাসায় ফেরার পথে উঁচু একটা জায়গা পড়ে। রিকশাওয়ালাদের টানতে কষ্ট হয়। মানুষজন নেমে যায়, আমিও নেমে গেলাম। দেখি কলেজ ড্রেস পরা ৪ জন ছেলেমেয়ে (কাপল খুব সম্ভবত, মেয়ে দুটোর হাতে গোলাপ ফুল) হেঁটে যাচ্ছে। এক জীবনে ভালোবেসে ভরবে না এই মন... বিখ্যাত এই গানের সুরে হঠাৎ একটা ছেলে গেয়ে উঠলো “এক জীবনে **** করে ভরবে না এই মন”। মেয়ে দুটো খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমি আর রিকশাওয়ালা মামা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।

-

পৃথিবীর পথে চলতে চলতে এমন কতো কী যে দেখা হয়ে গেল! মুক্ত বাতাসের খোঁজে বই পড়ার পর কতো অসংখ্য মানুষ আমাদের সাথে যোগাযোগ করে অন্ধকার জীবনের গল্প শোনালো...সবকিছু বলা সম্ভব না। বলা উচিতও না। বিশ্বাস করার, হজম করার সামর্থ্যও আমাদের অনেকেরই আর নেই। শুধু একটা কথা বলি...কোনো মানুষকেই এখন আর বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারি না।

শুধু যে দেখেই গিয়েছি, চুপচাপ থেকেছি–এমন না। অভিভাবকদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দেখেছি বাবা-মারাও এগুলোকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছেন। এই যুগে, এই বয়সে ছেলেমেয়েরা এমন করবেই, এটাতে তেমন ক্ষতির কিছু নেই–এমনই তাদের চিন্তাভাবনা। অথচ ছোট থাকতে আমি নিজেই কতো অভিভাবকের হয়ে চকলেট, সন্দেশের বিনিময়ে গোয়েন্দাগিরি করেছি। বড় আপু, বড় ভাইয়াদের কোচিং, প্রাইভেটে যাবার পথে আড়ি পেতে থেকেছি, পিছু নিয়েছি। চিঠি উদ্ধার করেছি।

১৫-২০ বছরের ব্যবধানেই সমাজ কতো বদলে গেছে! আজকাল মনে হয় এই পৃথিবীকে আমি আর চিনি না।এই পৃথিবীতে আমি স্রেফ একজন আগন্তুক!