Published on

আলকেমি (২)

ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটালের গবেষক ২১-২৮ বছর বয়সী কয়েকজন পুরুষকে সুন্দরী নারীদের ছবি দেখায়। দেখা গেল, ছবি দেখা মাত্রই তাদের ব্রেইনের রিওয়ার্ড সেন্টার (reward center) সক্রিয় হয়ে গেল। কোকেইনের মতো মাদকও ঠিক একইভাবে মস্তিষ্কের এই অংশকে সক্রিয় করে ক্ষণিকের ভালো লাগা তৈরি করে। আসক্তি তৈরি করে। অর্থাৎ মোটামুটি সুন্দরী নারীদের একবার দেখলে, বারবার দেখার জন্য পুরুষের ব্রেইনে আসক্তি তৈরি হয়।[1]

আসলে সৃষ্টিগতভাবেই পুরুষ এমন যে আশপাশে কোনো নারী থাকলে অবচেতনভাবেই সেদিকে তার চোখ চলে যায়। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান ফ্র্যানসিস্কোর সাইকিয়াট্রির ক্লিনিক্যাল প্রফেসর ড. লুঅ্যান ব্রিযেনডাইন_। ভদ্রমহিলা অ্যামেরিকান বোর্ড অফ সাইকিয়্যাট্রি অ্যান্ড নিওরোলজিরও একজন সদস্য। মস্তিষ্কের যে অংশ যৌনতার অনুভূতি তৈরি করে তা নারীদের তুলনায় পুরুষের মস্তিষ্কে ২.৫ গুণ বড়। ড. ব্রিযেনডাইনের মতে, এটাই সম্ভবত নারী আর পুরুষের ব্রেইনের সবচেয়ে বড় পার্থক্য। তিনি আরো বলেন, ‘আশেপাশে মেয়ে থাকলে পুরুষের চোখ সেদিকে যায়। তাদের শরীরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় সম্মোহিত ব্যক্তির মতো নজর আটকে যায়। আমি যদি বলতে পারতাম যে এই সম্মোহিত হওয়া থেকে পুরুষরা নিজেদের রক্ষা করতে পারে! কিন্ত না, বাস্তবতা হলো তাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব না। তাদের ভিসুয়াল ব্রেইন সার্কিট এমন ভাবেই তৈরি যে, তা সবসময় প্রজননের জন্য উর্বর সঙ্গী খুঁজতে থাকে। আশেপাশ দিয়ে যে নারীই যাক, ইচ্ছা না থাকলেও অবচেতন ভাবেই পুরুষ তাদের দিকে তাকায়_–প্রজননের জন্য উর্বর সঙ্গী খোঁজে’।[2]

সৌন্দর্য দেখে নারীরাও প্রভাবিত হয়। গবেষণায় দেখা যায়, কোনো কাজের আগে যদি নারীরা সুদর্শন পুরুষের সংস্পর্শে আসে তাহলে কাজে যাবার সময় তারা বেশি উত্তেজক পোশাক পরে নেয়।[3]

গবেষকরা বলেছেন, চেহারার সৌন্দর্যের চেয়ে পুরুষ বেশি গুরুত্ব দেয় শরীরের সৌন্দর্যকে, ফিগারকে। বিশেষ করে ‘বালুঘড়ি’র মতো গড়ন (hourglass figures, কোমর ও নিতম্বের অনুপাত ০.৭) পুরুষের পছন্দ। কারণ পুরুষের মস্তিষ্ক ধরে নেয় এ ধরনের শরীরের অধিকারী নারীরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং প্রজননের জন্য উর্বর।[4]

নিউযিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েলিংটনের নৃতাত্ত্বিক ড. বার্নাবি ডিক্সনের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়–সব পুরুষের চোখ প্রথমেই নারীর যে অঙ্গে আটকায় তা হলো বুক আর কোমর। সবচেয়ে বেশি সময় দৃষ্টি আটকে থাকেও এই দুই জায়গায়।[5]

পুরুষ উত্তেজিত হয় দেখার দ্বারা (visuo-sexual), বিপরীতে নারী উত্তেজিত হয় স্পর্শ দ্বারা। একটা পা, বুক বা ঠোঁটের ছবি দেখেও পুরুষ উত্তেজিত হয়ে কাম মেটাতে পারে, যে কামের মধ্যে প্রেমের কোনো বালাই নেই। তাই পর্নোগ্রাফির ভোক্তা মূলত পুরুষ। কোটি কোটি টাকা খরচ করে পুরুষ নারীর নগ্ন দেহ দেখে। পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীর পা, পিঠ, পেট, বুক, হাত, হিপ ব্যবহার করা ডালভাতের মতো হলেও, পুরুষের পা পিঠ হিপ ব্যবহার করে কিন্তু বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না–কারণ এটা আকর্ষণ জাগাতে পারে না।[6] আলাদা করে পুরুষদেহ বা পুরুষাঙ্গ নারীর আগ্রহের জায়গা না।

নারীর কণ্ঠ শুনেও পুরুষ আকর্ষণ বোধ করে। কণ্ঠের মাধুর্য থেকেই প্রথম সেক্সের সময় সেই নারীর বয়স কতো ছিল, যৌনসঙ্গীর সংখ্যা কতো, অবৈধ যৌনসঙ্গী আছে কিনা, তাকে পটানো যাবে কি না–ইত্যাদি নানা ব্যাপারে অনেক পুরুষ ধারণা করে নেয়।[7]

শিকাগোর স্মেল অ্যান্ড টেইস্ট ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশানের ডিরেক্টর অ্যালান হার্শ দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন, ‘সুগন্ধি মস্তিষ্কের সেই জায়গাগুলোকে উত্তেজিত করে যেগুলো যৌনাকাঙ্ক্ষার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। আর এর ফলে পুরুষের মনে যৌনচিন্তা চলে আসে’।

অসংখ্য পুরুষের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে গার্লফ্রেন্ড, এমনকি সম্পূর্ণ অপরিচিত নারীর দেহের সুগন্ধি তাদেরকে যৌনতার জন্য পাগল করে দেয়।[8],[9]

লাল লিপস্টিক, লাল রঙের পোশাক, স্লিভলেস পোশাক, হাই হিল, মিনি স্কার্ট, লেগিংস, স্কিনি জিন্স, ডেনিম জ্যাকেট, লনজারে, নাইট গাউন এসব পোশাক পরা নারীদের বিজ্ঞাপনে যেমন অহরহ দেখা যায়, তেমনি ফ্যাশন হিসেবেও এগুলোর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। কারণ ঐ একটাই–এই পোশাকগুলো পরা নারীদের প্রতি পুরুষেরা তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে।[10]

যেসব নারীরা লিপস্টিক দেয় না, তাদের চেয়ে লিপস্টিক দেওয়া নারীদের ছেলেরা প্রেমের প্রস্তাব বেশি দেয়।[11] গবেষকরা বলছেন–নারীর যৌন হেনস্থার পেছনে যে বিষয়টি কাজ করে তা হলো নারীকে রক্ত মাংসের মানুষ না ভেবে, একদলা মাংসপিণ্ড বা বস্তু মনে করা। নারীকে যখন বস্তু মনে করা হয়, তখন তার যে আবেগ অনুভূতি আছে, সে যে কষ্ট পায়–এই বিষয়গুলো আর মাথায় কাজ করে না। একজন মানুষ (পুরুষ/নারী) কেন একজন নারীকে বস্তু মনে করে, তার একটা উত্তর পাওয়া যাচ্ছে ইতালির, ইউনিভার্সিটি অফ ট্রেনটো’র সাইকোলজি এবং কগনিটিভ সায়েন্স বিভাগের (CiMEC) গবেষকদের কাছে। তারা বলছেন, বিকিনি বা অন্তর্বাস পরা মেয়েদেরকে অন্য পুরুষ এবং নারীদের মস্তিষ্ক বস্তু হিসেবে দেখে। একই কথা বলছেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির প্রফেসর সুস্যান ফিস্ক। তিনি আরো বলছেন, পুরো শরীর কাপড়ে ঢাকা আছে এমন মহিলাদের চেয়ে, বিকিনি পরা নারীদেহ পুরুষদের মাথায় বেশিক্ষণ থাকে।

একটি গবেষণায় পুরুষদের প্রথমে উত্তেজক পোশাক পরা নারীদের ছবি দেখানো হয়। তারপর অন্য সেটাপে অন্য একজন নারীর সাথে বসানো হয়। দেখা যায়, উত্তেজক পোশাকের নারীর ছবি দেখার কারণে পুরুষদের মাথায় তখন শুধু যৌনতার চিন্তা ঘোরাফেরা করছে। তারা সেই নারীর কাছাকাছি গিয়ে বসছে।

এরকম অসংখ্য গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, নারী খোলামেলা পোশাক পরলে[12] পুরুষেরা তাকে বেশি সেক্সি, বেশি আকর্ষণীয় মনে করছে। ধরে নিয়েছে, এই মেয়ে অলরেডি সেক্স করে ফেলেছে, এ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সেক্স করে। এর সাথে সহজেই প্রেম করা যাবে, বিয়ের বাইরেও যৌনতায় লিপ্ত হওয়া যাবে, যৌন হেনস্থা করা যাবে…এমনকি ধর্ষণও করা যাবে। কিন্তু রক্ষণশীল পোশাকের ক্ষেত্রে এমন হয়নি।[13]

বিজ্ঞানমনস্ক, সুশীল প্রগতিশীলরা সবক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে কষ্টিপাথর মানলেও নারী পুরুষের সাইকোলজি এবং হিউম্যান বায়োলজির এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের দেওয়া উপসংহারগুলো মানতে চায় না। সরাসরি অস্বীকার করে। নারীর শরীর, অবাধ মেলামেশা, পোশাক, কথাবার্তা, নারীপুরুষের সহজাত আকর্ষণ, যৌনতার প্রভাবক, মানুষকে যে এভাবেই বানানো হয়েছে–এ বাস্তবতাগুলো তারা অস্বীকার করে। নারীরা যা খুশি তাই পরুক, পুরুষ কেন তাদের দিকে তাকাবে, ‘মন পবিত্র’ রেখে নারী-পুরুষ স্রেফ বন্ধু হয়ে থাকতে পারে–এমন অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক সব দাবিও তারা জোরেশোরে প্রচার করে। কেউ ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে গেলে ধর্মান্ধ, উগ্রবাদী ইত্যাদি ট্যাগ মেরে দেয়।

কিন্তু ইসলাম এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে এবং বাস্তবতা অনুযায়ী বিধান দেয়। নারীপুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান এবং শরীয়াহর মূলনীতিগুলো নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো। তবে উপরের এটুকু আলোচনা থেকেই আল্লাহর দেওয়া বিধানগুলোর পেছনে থাকা গভীর হিকমাহ আমরা কিছুটা হলেও ধরতে পারি।

পর্দার বিধান, নজর নিয়ন্ত্রণের আদেশ, নারীপুরুষের মেলামেশাকে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, রাস্তাঘাটে আড্ডা দেওয়াকে অনুৎসাহিত করা, বিয়ে সহজ করা, নারীর কণ্ঠের ব্যাপারে সতর্কতা, এমনকি ঘরের বাইরে নারীর সুগন্ধি ব্যবহারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাসহ ইসলামের প্রতিটি বিধান মানুষের ফিতরাহ এবং নারী ও পুরুষের জৈবিক আকর্ষণের বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।[14] ইসলাম শুধু মানুষকে নিষেধ করে না, বরং এমন এক পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা দেয়, যা মানুষকে গুনাহ থেকে দূরে থাকতে এবং আল্লাহর আনুগত্য করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে আধুনিক সেক্যুলার বিশ্বকাঠামো এমন এক চিন্তাধারা এবং ব্যবস্থা তৈরি করে যা ক্রমাগত মানুষকে গুনাহর দিকে ঠেলে দেয়।


[1]Beautiful Faces Trigger Reward Center of Brain, ABC News-

tinyurl.com/34frurf9

[2]Love, sex and the male brain, CNN,March 25, 2010- https://archive.is/5ZEE0

[3] Durante, K. M., Griskevicius, V., Hill, S. E., Perilloux, C., & Li, N. P. (2011). Ovulation, female competition, and product choice: Hormonal influences on consumer behavior. Journal of Consumer Research, 37(6).

[4] Why Science Says Men Go for Women with Hourglass Figures, menshealth.com, Jun 18,2019- tinyurl.com/d2xzfwmv

[5] Dixson, B. J., et al. (2011). Eye tracking of men’s preferences for female breast size and areola pigmentation. Archives of Sexual Behavior, 40(1).

[6]Men and the Power of the Visual, PragerU, - tinyurl.com/y3c9yvy4

[7] Hughes, S. M., Dispenza, F., & Gallup Jr, G. G. (2004). Ratings of voice attractiveness predict sexual behavior and body configuration. Evolution and Human Behavior, 25(5), 295-304.

O'Connor, J. J., Re, D. E., & Feinberg, D. R. (2011). Voice pitch influences perceptions of sexual infidelity. Evolutionary Psychology, 9(1).

[8] Hirsch, A., & Gruss, J. (1999). Human male sexual response to olfactory stimuli. J Neurol Orthop Med Surg, 19, 14-19.

Scents That (Really!) Seduce Him, Cosmopolitoan- tinyurl.com/mz92r4h4

[9] এরকম আরও অনেক গবেষণা রয়েছে। সেগুলোর জন্য দেখা যেতে পারে চিকিৎসক, লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট ডা. শামসুল আরেফিন শক্তি রচিত ‘মানসাংক’ বইটি। আমাদের এই লেখার বেশ কিছু তথ্য মানসাংক বইটি থেকে নেওয়া হয়েছে।

[10] Elliot, A. J., & Niesta, D. (2008). Romantic red: red enhances men's attraction to women. Journal of personality and social psychology, 95(5).

The Red-Dress Effect Men see women wearing red as more open to romantic advances, science.org- tinyurl.com/mhd5vkh5

3 Universally Attractive Outfits, According to Science,whowhatwear.com, - tinyurl.com/2p99pr3w

5 Items That Make Women Scientifically More Attractive to Men, whowhatwear.co.uk - tinyurl.com/yc6s3e4v

Do Men Like a Woman in Red Lipstick? The Answer May Surprise You, stylecaster.com,Sep 04, 2013- tinyurl.com/yckzbvw8

[11] Guéguen, N. (2012). Does red lipstick really attract men? An evaluation in a bar. International Journal of Psychological Studies, 4(2), 206.

[12] এটা ইচ্ছাকৃতভাবে পুরুষদের পুরুষদের প্রলুব্ধ করার জন্য হতে পারে, অথবা এমনিই নিজের ভালোলাগায় পরা হতে পারে। কিন্তু নারী পুরুষদের প্রলুব্ধ করতে না চাইলেও পুরুষরা সব সময় একই অর্থ করেছে।

[13] Awasthi, B. (2017). From Attire to Assault: Clothing, Objectification, and De-humanization–A Possible Prelude to Sexual Violence?. Frontiers in psychology, 8, 338.

Guéguen (2011). The Effect of Women's Suggestive Clothing on Men's Behavior and Judgment: A Field Study

Researchers study sexual objectification in brain processes, medicalxpress.com, May 1, 2019 -https://archive.is/aQpVa

Johnson, K., Lennon, S. J., & Rudd, N. (2014). Dress, body and self: Research in the social psychology of dress. Fashion and Textiles, 1(1)

Men see bikini-clad women as objects, psychologists say, CNN, tinyurl.com/3uvcm42c

[14] ‘...তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় করো, তাহলে পরপুরুষের সঙ্গে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, যাতে যার অন্তরে ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়।...’ [সূরা আহযাব, আয়াত ৩২]

Woman's Voice in Quran, Islamweb - tinyurl.com/5bx6vwyf

নবী (ﷺ) বলেছেন - প্রত্যেক চোখই ব্যভিচারী। আর মহিলা যদি (কোনো প্রকার) সুগন্ধি ব্যবহার করে কোনো (পুরুষের) মজলিসের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, তবে সে ব্যভিচারিণী।’ তিরমিযী ২৭৮৬, আবূ দাঊদ ৪১৭৩ (আংশিক), সহীহুল জামে ৪৫৪০। ইমাম তিরমিযী হাদিসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।