Published on

আরশের ছায়া

বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম

প্রাণপ্রিয় ভাই, আমরা জানি, বর্তমানে বিভিন্ন কারণে যুব সমাজ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। অনেক যুবক বিভিন্ন পঙ্কিল অন্ধকারের পথে নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেনা-ব্যাভিচার হয়ে দাঁড়িয়েছে খুব সাধারণ ব্যাপার। অথচ ইসলামে এ কাজটি কঠিনভবে নিষিদ্ধ। এর জন্য রয়েছে অত্যন্ত কঠিন শাস্তি। পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তি যদি এ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে তার জন্য রয়েছে বিরাট পূরস্কার। আজকের এই পোষ্টে কোন ব্যক্তি সুযোগ পাওয়ার পরেও যদি এ ঘৃণিত অপকর্ম থেকে বিরত থাকে তাহলে তার জন্য আল্লাহ তাআলা কী পুরস্কার ঘোষণা করেছেন তা কুরআন ও হাদীসের আলোকে অতি সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।

কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দান:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ تَعَالَى فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ إِمَامٌ عَادِلٌ وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللَّهِ وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ وَرَجُلَانِ تَحَابَّا فِي اللَّهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاه

“যে দিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া কোন ছায়া থাকবেনা সে দিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাঁর আরশের নিচে ছায়া দান করবেন। তারা হলেনঃ

(১) ন্যায়পরায়ণ শাসক

(২) যে যুবক তাঁর প্রভুর এবাদতের মাঝে প্রতিপালিত হয়ে বড় হয়েছে।

(৩) যে ব্যক্তির মন সর্বদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে।

(৪) এমন দুই ব্যক্তি, যারা আল্লাহর সন্তষ্টির জন্যে একে অপরকে ভালবাসে। আল্লাহর জন্য তারা পরস্পরে একত্রিত হয় এবং আল্লাহর জন্য পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়।

(৫) এমন পুরুষ যাকে একজন সুন্দরী ও সম্ভ্রান- বংশের মহিলা নিজের দিকে আহবান করে, আর সে পুরুষ বলেঃ আমি আল্লাহকে ভয় করি। (তাই তোমার ডাকে সাড়া দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়)।

(৬) যে দানশীল ব্যক্তি এমন গোপনে দান করে, ডান হাত দিয়ে যা দান করে, বাম হাত তা অবগত হতে পারেনা। অর্থাৎ তিনি কেবল আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনের জন্যেই দান করেন। তাই মানুষকে শুনানো বা দেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনা।

(৭) যে ব্যক্তি নির্জনে বসে আল্লাহকে স্মরণ করে চোখের পানি প্রবাহিত করে”।

(সহীহ বুখারী)

আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার মর্যাদা লাভঃ

ইউসুফ (আঃ)এর ঘটনাটি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি এই মহান মর্যাদা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। এই ঘটনায় যুবকদের জন্য শিক্ষার বিষয় রয়েছে। ঘটনাটি আল্লাহ্‌ তাআলা কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করে বলেনঃ

وَرَاوَدَتْهُ الَّتِي هُوَ فِي بَيْتِهَا عَنْ نَفْسِهِ وَغَلَّقَتِ الأبْوَابَ وَقَالَتْ هَيْتَ لَكَ قَالَ مَعَاذَ اللَّهِ إِنَّهُ رَبِّي أَحْسَنَ مَثْوَايَ إِنَّهُ لا يُفْلِحُ الظالمون الظَّالِمُونَ

“আর সে ইউসুফ(আ) যে মহিলার ঘরে ছিল ঐ মহিলা তাকে ফুসলাতে লাগল এবং দরজাসমূহ বন্ধ করে দিল। সে মহিলা বলল: শুন, তোমাকে বলছি, এদিকে আস! সে বলল: আল্লাহ্‌ রক্ষা করুন; (তোমার স্বামী) আমার মালিক। তিনি আমাকে সযত্নে থাকতে দিয়েছেন। নিশ্চয় সীমা লংঘনকারীগণ সফল হয় না”। (সূরা ইউসুফঃ ২৩)

কে এই মহিলা? তিনি হচ্ছেন মিশরের শাসক আযীযের স্ত্রী। কুরআনের ভাষা অনুযায়ী বুঝা যায় ইউসূফ (আ এর অন্তরে বিষয়টি ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং তিনি তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছিলেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তিনি এ কাজ থেকে বিরত থাকেন। আল্লাহ্‌ তার অন্তর থেকে অশ্লীল কাজের চিন্তা দূর করে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর খালেস বান্দা। এভাবেই আল্লাহ্‌ মুত্তাকীদেরকে রক্ষা করেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেনঃ

وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلا أَنْ رَأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ

“ নিশ্চয় মহিলা তাঁর বিষয়ে চিন্তা করেছিল এবং সে ইউসুফ (আ) ও মহিলার বিষয়ে চিন্তা করত। যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার মহিমা অবলোকন করত। এমনিভাবে হয়েছে, যাতে আমি তার কাছ থেকে মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয় সে আমার মনোনীত বান্দাদের একজন। (সূরা ইউসুফঃ ২৪)

যে যুবক তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ

قَالَ مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ

“যে ব্যক্তি তার মুখ ও লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে আমি তার জন্যে বেহেশতের জিম্মাদার হবো”। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

"আর ব্যভিচারের কাছেও যেও না, নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। " (আয়াত নং-৩২, সূরা নং- ১৭, বনী-ইসরাইল)

ব্যভিচার পরিত্যাগ করার উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করলে তা কবুল হয় এবং আল্লাহ বিপদ থেকে রক্ষা করেনঃ সহীহ বুখারীতে উল্লেখিত বিখ্যাত তিন ব্যক্তির ঘটনাটি পড়ুন এবং দেখুন, আল্লাহ তাআলা কিভাবে তাদেরকে কঠিন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।

ইবনে উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন যে, “অতীত কালে তিনজন লোক পথ চলছিল। পথিমধ্যে রাত্রি যাপন কারার জন্য তারা একটি পাহাড়ের গুহায় ঢুকে পড়ল। উপর থেকে বিশাল আকারের একটি পাথর গড়িয়ে এসে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। তাদের জন্য বের হওয়ার কোন সুযোগ অবশিষ্ট রইলনা। তাদের একজন অপরজনকে বলতে লাগল, তোমরা প্রত্যেকেই আপন আপন সৎআমল আল্লাহর দরবারে তুলে ধরে তার উসীলা দিয়ে দু’আ করা ব্যতীত এই পাথর থেকে রেহাই পাওয়ার কোন উপায় নেই।

তাদের একজন বললঃ হে আল্লাহ! আমার পিতা-মাতা অতি বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হয়েছিল। আমি তাদের পূর্বে আমার পরিবার-পরিজন কিংবা দাস-দাসীকে দুধ পান করাতাম না। একদিন ঘাসের সন্ধানে আমি অনেক দূরে চলে গেলাম। তারা ঘুমিয়ে পড়ার পূর্বে আমি ফেরত আসতে পারলাম না। আমি তাদের জন্য দুধ দহন করলাম। অতঃপর আমি তাদেরকে পেয়ালা নিয়ে তাদের মাথার পাশে দাড়িয়ে রইলাম। আমি তাদের পূর্বে স্ত্রী-পরিবার এবং দাস-দাসীকে দুধ পান করানো অপছন্দ করলাম। দুধের পেয়ালা হাতে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম তাদের জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষায়। এভাবে সারা রাত কেটে গিয়ে ফজর উদীত হলে আমার পিতা-মাতা ঘুম থেকে জেগে দুধ পান করলেন। হে আল্লাহ! আমি একাজটি একমাত্র আপনার সন’ষ্টি অর্জনের জন্য সম্পাদন করেছি। সুতরাং আমরা এই পাথরটির কারণে আমরা যে বিপদে পড়েছি তা থেকে আমাদেরকে উদ্ধার করুন। এভাবে দু’আ করার সাথে সাথে পাথরটি একটু সরে গেল,কিন্তু তখনও বের হওয়ার মত রাস্তা হয়নি।

দ্বিতীয় ব্যক্তি বললঃ হে আল্লাহ! আমার একজন চাচতো বোন ছিল। তাকে আমি খুব ভালবাসতাম। আমি তার কাছে আমার মনোবাসনা পেশ করলাম। সে অস্বীকার করল। অবশেষে এক বছর খুব দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। তখন সে খাদ্যাভাবে পড়ে সাহায্যের জন্য আমার নিকট আসল। আমি তাকে একশত বিশ দিরহাম দিলাম এই শর্তে যে, সে আমার সাথে নির্জনে সাক্ষাৎ করবে। সে এতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু আমি যখন সম্পূর্ণ সুযোগ লাভ করলাম এবং তার দুই উরুর মাঝখানে বসে পড়লাম তখন সে বলতে লাগলঃ হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর। অন্যায়ভাবে মোহর ভঙ্গ করো না অর্থাৎ অন্যায়ভাবে তুমি আমার সতীত্ব হরণ করতে করো না। ফলে আমি তার সাথে সহবাস করাকে পাপের কাজ মনে করলাম। সুতরাং সে আমার সবচেয়ে কাছে হওয়া সত্বেও আমি তার কাছ থেকে চলে আসলাম। আর আমি তাকে যে একশটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলাম তাও ছেড়ে দিলাম। হে আল্লাহ! আমি যদি একাজটি একমাত্র আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সম্পাদন করে থাকি তাহলে আমরা এই পাথরটির কারণে আমরা যে বিপদে পড়েছি তা থেকে আমাদেরকে উদ্ধার করুন। এভাবে দু’আ করার সাথে সাথে পাথরটি একটু সরে গেল, কিন্তু তখনও বের হওয়ার মত আবস্থা হয়নি।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তৃতীয়জন বললঃ হে আল্লাহ! নির্ধারিত মজুরীর বিনিময়ে আমি কয়েকটি শ্রমিক নিয়োগ করলাম। কাজ শেষে আমি তাদেরকে পারিশ্রমিক প্রদান করলাম। কিন্তু একজন লোক মজুরী গ্রহণ না করেই চলে গেল। আমি তার প্রাপ্য টাকা বাড়াতে থাকলাম। একপর্যায়ে তা প্রচুর সম্পদে পরিণত হল। কিছুকাল পর সে আমার নিকট এসে বললঃ হে আল্লাহর বান্দা! আমার মজুরী দিয়ে দাও। আমি তাকে বললামঃ এসব উট, গরু, ছাগল এবং গোলাম যা তুমি দেখতে পাচ্ছ তা সবই তোমার। সে বললঃ হে আল্লাহর বান্দা! আমার প্রাপ্য দিয়ে দাও এবং আমার সাথে বিদ্রুপ করোনা। আমি বললামঃ আমি তোমার সাথে বিদ্রুপ করছিনা; বরং এগুলো তোমারই। অতঃপর সে সমস- সম্পদ নিয়ে চলে গেল। একটিও রেখে যায়নি। হে আল্লাহ! আপনি যদি মনে করেন যে, আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্য একাজটি করেছি, তাহলে আজ আমাদেরকে এখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। সাথে সাথে পাথরটি সম্পূর্ণরূপে সরে গেল। তারা নিরাপদে সেখান থেকে বের হয়ে এল।” (সহীহ বুখারী)

যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করে পবিত্রতার সাথে জীবন যাপন করে আল্লাহ তার সকল সমস্যা দূর কর দেন,তার অর্থ-সম্পত্তিতে বরকত দান করেন এ ছাড়াও তার জন্য রয়ছে অসংখ্য পুরস্কার। সর্বপরি আল্লাহ পরকালে তার জন্য প্রস্তুত করে রেখছেন চিরসুখের নিবাস জান্নাত। আসুন, মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা জানাই, হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে তোমার প্রতিশ্রুত জান্নাত থেকে বঞ্চিত করনা। আমাদেরকে কুলশমুক্ত পবিত্র জীবনগঠনের তাওফীক দাও। সেই সাথে আমাদের যুব সমাজকে অধ:পতনের হাত থেকে রক্ষা কর আর তাদেরকে বানাও আলোকিত পথের রাহবার। তুমিই একমাত্র সাহায্যকারী।

[ কৃতজ্ঞতাঃ বিবাহ একটি উত্তম বন্ধুত্ব ]