‘মাদকের রাজ্যে’
- lostmodesty
- Saturday 01 September 2018
- 10 MIN READ

‘মাদকের রাজ্যে’
মেঘের অনেক রং।
কখনো রক্তের মতো টকটকে লাল।
কখনো নীল।
কখনো সবুজ।
কখনো সজনে ফুলের মতো সাদা।
এখন অবশ্য মেঘের রং ধূসর।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।
মন খারাপ করে দেওয়া বৃষ্টি।
সেদিন সকালে বৃষ্টি ছিল কিনা মনে নেই, তবে কেন জানি আমার মন খারাপ ছিল ভীষণ। বিক্ষিপ্ত ভাবে নেট ব্রাউজিং করছিলাম। হটাৎই একটা লিখা চোখে পড়ল। কে জানতো এই লিখাটি বদলে দিবে আমার জীবনের গতিপথ!
লেখকের মুন্সিয়ানা আছে বটে, বাস্তব ঘটনা, তথ্য উপাত্ত আর কিছু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আশ্চর্য এক কাহিনী ফেঁদে বসে আছেন; পর্ন আসক্তি নাকি কোকেইন বা হিরোইন আসক্তির মতোই ক্ষতিকর! এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম লিখাটি। হজম করতে সময় লাগলো কিছুটা।
পর্ন দেখলে আপনার যে ক্ষতিটা হবে কোকেইন,হিরোইন ইত্যাদি কড়া মাদক সেবনেও আপনার একই ক্ষতি হবে! শুধু তাই না পর্ন আসক্তি আপনার মস্তিষ্কের গঠণই বদলে ফেলবে!
কিন্তু কেন? আপনি কিছু খেলেন না, পান করলেন না, ঘরের এককোণে বসে বসে পর্ন দেখলেন তারপরেও কেন কোকেইন বা হিরোইন সেবনের মতো ক্ষতির শিকার হবেন আপনি? কেন আপনার মস্তিষ্ক পরিবর্তিত হয়ে যাবে?
এই ‘কেন’র উত্তর পাবার জন্য বিজ্ঞানের কিছু কচকচানি শুনতে হবে। চেষ্টা করছি যতোটা সম্ভব সহজ ভাবে বোঝানোর।
আমাদের মস্তিষ্কের একটা অংশকে বলা হয় রিওয়ার্ড সেন্টার। এটার কাজ হল আপনাকে পুরষ্কৃত করার মাধ্যমে আনন্দের অনুভূতি দেওয়া, বেঁচে থাকার প্রেরণা দেওয়া[1,2]। সহজ বাংলায় বলি, ছোট বেলায় ফেলুদা পড়ার নেশা ছিল। বাসা থেকে বলতো পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট কর তাহলে ফেলুদার বই কিনে দেওয়া হবে। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার পর আমাকে ফেলুদার বই কিনে দিয়ে ভালো ফলাফলের জন্য পুরুষ্কৃত করা হল। রিওয়ার্ড সেন্টার ঠিক এই কাজটাই করে। যেসব কাজগুলো আপনার জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ভালো কিছু খাওয়া,কিছু পাবার জন্য কঠোর পরিশ্রম করা সেই সব কাজগুলোর জন্য আপনাকে প্রেরণা দিবে এবং কাজ শেষ হলে পুরষ্কার প্রদান করবে।
কিন্তু রিওয়ার্ড সেন্টার কীভাবে আমাদের পুরষ্কৃত করে? মেকানিজম টা কী?
রিওয়ার্ড সেন্টার এই পুরষ্কার দেবার জন্য ডোপামিন এবং অক্সিটোসিন নামের দুটি কেমিক্যাল রিলিজ করে। এই কেমিক্যাল গুলো পাইকারী হারে উৎপন্ন হয় যখন রিওয়ার্ড সেন্টার অনুভব করে পুরষ্কার দেওয়ার মতো কিছু ঘটেছে। এই দুইটি কেমিক্যাল উৎপন্ন হলেই খেল খতম... এরপর আকাশে বাতাসে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। আনন্দম, আনন্দম,আনন্দম।[3]
কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো এই ‘রিওয়ার্ড সেন্টারটি’ খুব সহজেই বেহাত হয়ে যায়। [4]
আফিম বা কোকেন জাতীয় মাদকদ্রব্য কোন প্রকার ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াই ‘আরামসে’ রিওয়ার্ড সেন্টারকে উত্তেজিত করে তোলে। মস্তিষ্কে ডোপামিন আর অক্সিটোসিনের জলোচ্ছ্বাস শুরু হয় পরিণতিতে কবি গুরুর ভাষায় ‘সুখের মতো ব্যাথা’ অনুভূত হতে থাকে। [5]
পর্নও, মাদক দ্রব্যের মতো খুব সহজেই মস্তিষ্কে ডোপামিনের বন্যা বইয়ে দিয়ে এর দর্শককে ক্ষনিকের জন্য সুতীব্র আনন্দ দিতে পারে [6]। পর্নআসক্ত এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা গিয়েছে তাদের মস্তিষ্কের গঠন হুবহু এক[7]। লেকিন পিকচার আভি বাকী হ্যায়...
ডোপামিন ব্রেইন পালসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুরুষ্কার পাবার নতুন রাস্তা তৈরি করে। যার ফলে এর দর্শক ঠিক আগের কাজটাতে ফিরে যায় যার কারণে প্রথমবার ডোপামিন নির্গত হয়েছিল। এই কারণেই এক বার পর্ন দেখলে বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। [8]
দুধের দাঁত পড়তে শুরু করেছে তখন কেবল। বহু কষ্টে ব্যাট তুলে ধরতে পারি । আশেপাশে আমার মতো কয়েকজন পিচ্চিকে নিয়ে একটা দল গঠন করা হল। বল থাকলেও ব্যাট ছিলনা। কারোরই সাহস ছিলনা বাবার কাছে ব্যাটের আবদার করার। অগ্যতা একজন তার বড় ভাইয়ের হাতে পায়ে ধরে তাল গাছের ডাল চেঁছে ব্যাট বানানোর ব্যবস্থা করল। সেই ব্যাট নিয়ে আমাদের কী যে আনন্দ!
কিছুদিন এটা দিয়ে জম্পেশ খেলা হল, কিন্তু তারপর তালের এই ব্যাট দিয়ে আর খেলতে ইচ্ছে করতোনা। ইতিমধ্যে আমরা কিছুট বড় হয়ে গিয়েছি। কাঠমিস্ত্রীদের দিয়ে নিম কাঠের সুন্দর একটা ব্যাট বানানো হল। নীলরঙা এই ব্যাট এখনো আমার চোখে ভাসে! কত ছক্কা যে মেরেছি এই ব্যাট দিয়ে! কিছুদিন পরে এই ব্যাট দিয়েও খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। চাঁদা তুলে বেশ দামী কাঠের বল খেলার ব্যাট কেনা হল।
এতো প্যাঁচাল পাড়ার একটাই উদ্দেশ্য আপনাদের বোঝানো যে মানুষ কোন কিছু নিয়ে খুব বেশীদিন সন্তুষ্ট থাকতে পারেনা। আল্লাহ্ (সুবঃ) মানুষকে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন।
পর্নআসক্তির ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে। ধরুন, আপনি কোন সফটকোর পর্ন দেখলেন, একটি নির্দিষ্ট মাত্রার ডোপামিন রিলিজ হল আপনি আনন্দ পেলেন। পর পর কয়েকবার পর্নমুভি দেখার পর ঠিক একই পরিমাণ ডোপামিন রিলিজ হলেও আপনি আগের মতো আর আনন্দ পাবেননা। আপনি আর এই পর্ন মুভিতে সন্তুষ্ট থাকতে পারবেননা। আপনার প্রয়োজন পড়বে নতুন কিছুর। কেন এমন হয়?
কারন মাত্রারিক্ত ডোপামিন রিলিজ হলে মস্তিষ্ক ডোপামিনের ব্যাপারে কম সংবেদনশীল হয়ে যায়। অতিরিক্ত ডোপামিনের প্রভাব থেকে আত্মরক্ষার জন্য মস্তিষ্ক কিছু Receptor Nerve বিসর্জন দেয় [9]। এই Receptor Nerve এর কাজ হল ডোপামিন অণু গ্রহণ করে মস্তিষ্ককে এই সিগন্যাল দেওয়া যে আমি এতো এতো পরিমাণ ডোপামিন গ্রহণ করেছি । যখন Receptor Nerve এর সংখ্যা কমে যাচ্ছে তখন ডোপামিন রিলিজ হলেও সেটা গ্রহণ করার জন্য পর্যাপ্ত Receptor Nerve থাকছে না এবং মস্তিষ্ক ধরে নিচ্ছে উপস্থিত ডোপামিনের পরিমাণ খুব কম। এ কারনেই সেই একই পর্নমুভি দেখেও আপনি আগের চেয়ে কম আনন্দ পাচ্ছেন।
পূর্বের মতো আনন্দ পাবার জন্য আপনি তখন ঝুঁকে পড়বেন হার্ডকোর পর্ন এর দিকে। এতে ডোপামিন রিলিজের মাত্রা বাড়বে এবং আপনি পাবেন সেই পূর্বের সুতীব্র আনন্দ। সফট কোর পর্ন দিয়ে শুরু করে ডোপামিন লেভেলের সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য আপনি ধীরে ধীরে গে পর্ন, লেসবিয়ান পর্ন,চাইল্ড পর্ন এর মতো জঘন্য ক্যাটাগরির পর্ন দেখা শুরু করবেন।[10]
মাদকাসক্তদের ক্ষেত্রেও কিন্তু ঠিক এমনটাই ঘটে। সিগারেট থেকে যে মাদকাসক্তির সূচনা হয় তার শেষ হয় কোকেইন , হিরোইন দিয়ে।[11,12]
আমাদের মস্তিষ্কের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হচ্ছে ফ্রন্টাল লোব। এই বাবাজির কাজ কী?
ল্যাবের করিডোর দিয়ে কোণ রূপবতী হেঁটে গেলে আপনার দুচোখে যে স্বপ্নের আবীর নামে তার জন্য দায়ী এই ফ্রন্টাল লোব। আমাদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম মানে ভাষা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের পারদর্শিতা, সর্বোপরি আমাদের ব্যক্তিত্ব নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই ফ্রন্টাল লোব। [13]
মাদকাসক্তি,অতিরিক্ত খাওয়াদাওয়া,ইন্টারনেট আসক্তি,পর্ন এই ফ্রন্টাল লোবের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। [14] ভয়ংকর ব্যাপার হলো- একজন মানুষ যতোবেশী পর্ণ দেখে, ঠিক ততোবেশী তার মস্তিষ্কের ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে, এবং ক্ষতি থেকে রিকভার করাটাও কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।[15]
আশাকরি বোঝা গিয়েছে আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও পর্নমুভি মুভি কী বিশাল ক্ষতি করে আপনার মস্তিষ্কের।
রেফারেন্সঃ
[1] Hilton, D. L., and Watts, C. (2011). Pornography Addiction: A Neuroscience Perspective. Surgical Neurology International, 2: 19; (http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3050060/) Bostwick, J. M. and Bucci, J. E. (2008). Internet Sex Addiction Treated with Naltrexone. Mayo Clinic Proceedings 83, 2: 226–230; Nestler, E. J. (2005). Is There a Common Molecular Pathway for Addiction? Nature Neuroscience 9, 11: 1445–1449; Leshner, A. (1997). Addiction Is a Brain Disease and It Matters. Science 278: 45–7.
[2] Bostwick, J. M. and Bucci, J. E. (2008). Internet Sex Addiction Treated with Naltrexone. Mayo Clinic Proceedings 83, 2: 226–230; Balfour, M. E., Yu, L., and Coolen, L. M. (2004). Sexual Behavior and Sex-Associated Environmental Cues Activate the Mesolimbic System in Male Rats. Neuropsychopharmacology 29, 4:718–730; Leshner, A. (1997). Addiction Is a Brain Disease and It Matters. Science 278: 45–7.
[3] Hedges, V. L., Chakravarty, S., Nestler, E. J., and Meisel, R. L. (2009). DeltaFosB Overexpression in the Nucleus Accumbens Enhances Sexual Reward in Female Syrian Hamsters. Genes Brain and Behavior 8, 4: 442–449; Bostwick, J. M. and Bucci, J. E. (2008). Internet Sex Addiction Treated with Naltrexone. Mayo Clinic Proceedings 83, 2: 226–230; Doidge, N. (2007). The Brain That Changes Itself. New York: Penguin Books, 108; Mick, T. M. and Hollander, E. (2006). Impulsive-Compulsive Sexual Behavior. CNS Spectrums, 11(12):944-955; Nestler, E. J. (2005). Is There a Common Molecular Pathway for Addiction? Nature Neuroscience 9, 11: 1445–1449; Leshner, A. (1997). Addiction Is a Brain Disease and It Matters. Science 278: 45–7.